জলবায়ু পরিবর্তনে মানব সভ্যতার ভূমিকাঃ
জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে সভ্যতার সংকট নাকি মানব সভ্যতার অনিয়ন্ত্রিত বিকাশের কারনে জলবায়ুর পরিবর্তন- এই প্রশ্ন বর্তমান কালে বিশ্লেষণ করার সময় আসন্ন। জলবায়ু পরিবর্তন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানবজীবনে তার প্রভাব নিয়ে আমাদের ভৌগোলিক ও পরিবেশবিদদের বর্তমান দিনে এক খাস্তা আলোচনা। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আমরা একবারও পর্যালোচনা করে দেখি না, যে প্রাকৃতিক উপাদানের পরিবর্তনের কারনে মানবজীবনে যেমন প্রভাব পড়ে, তেমন মানবীয় কার্যকলাপে প্রাকৃতিক বৈশিষ্টের পরিবর্তন ঘটে থাকে। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর কাছ থেকে আমরা জেনেছি গাছের প্রাণ আছে, ঠিক তেমনি ভাবে আমরা অনুসন্ধান করলে দেখতে পাব, গাছ কেন সমগ্র এই বিশ্ব প্রপঞ্চের আনাচে কানাচে যে সকল প্রাকৃতিক উপাদান পড়ে রয়েছে তাদের এক আপেক্ষিক প্রাণ বর্তমান। তাহলে আমাদের উচিত মানুষ প্রকৃতি সম্পর্ক বজায় রেখে প্রকৃতিকে মানবসভ্যতার গ্রাস থেকে রক্ষা করে তার মতো করে তাকে চলতে দেওয়া। কারন বর্তমানে বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্ত দিলেন বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণগুলির মধ্যে অন্যতম হল কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি, কিন্তু তারা বিশ্ব উষ্ণায়ন সংক্রান্ত সেমিনার করার সময় ঠাণ্ডা ঘরে বসতে বিরত থাকেন না। আমরা আরও লক্ষ্য করলে দেখতে পাই, একটি ছেলে বা মেয়েকে তার পূর্ণ যৌবনকালে যদি কোন সমাজের কুপ্রভাব গ্রাস করে তখন সেই ছেলে সমাজবিরোধী বা মেয়েটি পতিতা হয়ে আত্মপ্রকাশ করে, ঠিক তেমনিভাবে একটি নদী বা কোন প্রাকৃতিক উপাদানকে তার মত করে না চলতে দিয়ে মানুষের স্বার্থে মানুষের মত করে পরিচালিত করে তখন সেই প্রাকৃতিক উপাদানের অপমৃত্যু ঘটে কিংবা পরিবর্তন ঘটে যার ফলশ্রুতি হিসাবে জলবায়ুগত পরিবর্তনের প্রভাব টের পাওয়া যায়। সময়ের সাথে সাথে সরস্বতী নদী বা আদি গঙ্গার বিনাশ ঘটেছে মানুষেরই কারনে। আমরা সভ্য জগতের বাসিন্দারা অর্থাৎ বিজ্ঞানের বলে বলীয়ান হয়ে নিজেদের স্বার্থে সময়ের করাল গ্রাসের থাবা বসিয়ে দিয়েছি প্রকৃতির উপর। আমরা এই পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাহিদার যোগান বজায় রাখতে সংহার করেছি প্রকৃতিকে। ফলে তাদের অস্তিত্ব বিনাশ ঘটছে বা তাদের প্রকৃতিগত একটা পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। সম্পাদক মহাশয়ের আবেদনে আজ এমন একটি করুণ সত্যি নিয়ে কলম ধরছি, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নহে, বরং অন্য প্রভাবকের নিয়ন্ত্রনে জলাবায়ুর উপর প্রভাব বিস্তার লক্ষ্য করা গেছে।
যারা ছোটবেলা থেকে ভূগোলের পাতায় পড়েছেন, বিশ্বের বৃহত্তম লবণাক্ত হ্রদগুলির মধ্যে মধ্য এশিয়ার কাজাখস্থান – উজবেকিস্থানে অবস্থিত আরল সাগর চতুর্থ স্থানে, তাদের কাছে এই তথ্য একেবারে আঁতকে ওঠার মতো লাগবে যে কিছু লোভী রাষ্ট্রনেতার লোভ আর ভুল সিদ্ধান্তে সেই হ্রদের অপমৃত্যু এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। পৃথিবীর বুক থেকে এভাবে হারিয়ে যেতে পারে এক বিশাল জলাধার। আর সে ঘটনার প্রমাণ হিসেবে পৃথিবীর ইতিহাসের আড়ালে চলে গেছে এক বৃহৎ হ্রদ, যার নাম আরল সাগর। ৫০ বছরের মাথায় অন্যতম বৃহত্তম হ্রদ থেকে শুকনো মরুভূমিতে পরিণত হওয়া সেই আরল সাগরকে ঘিরে আমাদের আজকের আলোচনা। এই হ্রদের ভৌগোলিক অবস্থান ৪৫° উঃ অক্ষাংশ ও ৬০° পূঃ দ্রাঘিমা। মধ্য এশিয়ার এই সুবৃহৎ হ্রদ তথা আরল সাগ্রকে কেন্দ্র করে মৎস্য শিল্পের বিকাশ ঘটে আরল সাগরের তীরবর্তী এলাকায়। ধীরে ধীরে এর আশেপাশে জনবসতি গড়ে ওঠে।
বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম লবণাক্ত হ্রদ আরল সাগরঃ
আরল সাগর মূলত একটি হ্রদের নাম। আরল সাগরের অবস্থান বর্তমান কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান এবং মধ্য এশিয়া বিস্তৃত। আরবদের নিকট এই হ্রদটি তার বিশালতার কারণে সাগর হিসেবে পরিচিত ছিল। পরবর্তীকালে সারা বিশ্বে ঐ সাগর নামে পরিচিতি পায়। ১৯৬০ সালের দিকে আরল সাগর পৃথিবীর বুকে চতুর্থ বৃহত্তম হ্রদ ছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে আরল সাগরের বয়স প্রায় ৫.৫ মিলিয়ন বছর। হ্রদের জলের উৎস হিসেবে দুটি নদীর সন্ধান পাওয়া যায়। উত্তর থেকে সিরদরিয়া ও দক্ষিণ থেকে আমুদরিয়া নদী থেকে জল এসে মিশতো আরলের বুকে। মাছ শিকারীদের নৌকার সমাগমে মুখর থাকতো আরল সাগর। কিন্তু মাত্র কয়েক দশকে দুই দেশের স্বার্থ সুরক্ষিত করতে গিয়ে প্রকৃতির এই আশীর্বাদকে আরল সাগরের উপর নির্ভরশীল জনগণের কাছে অভিশাপে পরিণত করে তোলে এখানকার সরকারী নীতি। কয়েক দশকের উপেক্ষা আর অবহেলায় প্রাণচঞ্চল সুবিশাল হ্রদের অপমৃত্যু ঘটে। ৬৮ হাজার বর্গ কি.মি. আয়তনের হ্রদটির ধারন অববাহিকা প্রায় ১.৫৪৯ মিলিয়ন বর্গকিমি এলাকা জুড়ে। ১৯৯৬ সালের হিসাব অনুযায়ী এই হ্রদের সমগ্র আয়তনের প্রায় ৭০% শুকিয়ে গেছে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আরল সাগরের শুকিয়ে যাওয়ার ঘটনা বর্তমান পৃথিবীর জন্য এক অশনি বার্তা। এর শুকিয়ে যাওয়ার পেছনে বিজ্ঞানীরা একমাত্র মানুষকে দায়ী করেছেন।
সমস্যার সুত্রপাতঃ
আরল সাগর তীরবর্তী এলাকার আবহাওয়া মোটেও বসবাসের জন্য উপযুক্ত ছিল না। বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ মাত্র ১০০ মিলিমিটার, যা যেকোনো প্রাণীর বসবাসের জন্য প্রতিকূল। প্রতি লিটার জলে লবণের পরিমাণ ছিল গড়ে ১০ গ্রাম করে। হাতেগোনা কয়েক প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ বেঁচে থাকতো সেখানে। এদেরকে ঘিরে আরলের বুকে গড়ে উঠে ক্ষুদ্র মৎস্যশিল্প। কিন্তু এর শুকিয়ে যাওয়ার পেছনে মূল খলনায়ক তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। ঘটনার ঘনঘটা ১৯৬০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি সিদ্ধান্ত। অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের বাজারে দাপিয়ে বেড়াতে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রন। ১৯১৮ সালে গড়ে তোলা সোভিয়েত তুলা শিল্প তখন সফলতার শীর্ষে আরোহণ করেছিল। সোভিয়েত সরকার তাই বিশ্ব বাজার ধরে রাখতে তুলার উৎপাদন বৃদ্ধি করার প্রকল্প হাতে নেন। ৬০ এর দশকে সোভিয়েত সরকার সিদ্ধান্ত নেন যে উত্তর ও দক্ষিণ থেকে আগত আমুদরিয়া ও সিরদরিয়া নদী অর্থাৎ যাদের জলে এই আরল সাগর পুষ্ট, সেই নদীদ্বয়ের জলকে ব্যবহার করে তুলা শিল্পের বিকাশ বিশ্বের বাজারে বাড়াতে হবে। ফলতঃ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সিরদরিয়া এবং আমুদরিয়া, এই দুই নদীর জলকে আরল সাগরের চারদিকে শুষ্ক মরুভূমিপ্রায় মাটিতে তথা তুলা ক্ষেতে সেচের কাজে ব্যবহার করা হবে। সুদক্ষ ইঞ্জিনিয়ারদের সাহায্যে নদীর জল টেনে এনে তুলা চাষ অঞ্চলে সেচ করা হয়। যার ২৫ থেকে ৭৫ শতাংশ নষ্ট হয়ে যেত মরুভূমির মাটির টানে। ফলে আরল হ্রদের দিকে ধাবিত হওয়া জলের পরিমাণ কমে যায়। সময়ের সাথে সাথে এই আরল সাগরের সুবিশাল জলরাশির অন্যতম উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অর্থাৎ হ্রদের সাথে কোনো নদীর সংযোগ না থাকায় আস্তে আস্তে জলের পরিমাণ কমে যায়। কিন্তু সোভিয়েত সরকার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেননি।
পরিবেশগত বিপর্যয় ও জলবায়ুর পরিবর্তনঃ
যে আরলের বুকে অনন্ত জলরাশিকে পাথেয় করে স্থানীয় অধিবাসী ছাড়াও দুই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ মাছ ধরতে জাহাজ বা লঞ্চ করে আসত, সেখানে জলের পরিমাণ কমে যেতে থাকায় হ্রদের জলের লবণের ঘনত্ব মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে যায়। কারন শুধু জলের উৎস সংকট নহে পাশাপাশি বাষ্পীভবনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া। এর ফলে জলজ প্রাণীদের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। আরল সাগরের ধ্বংসের শুরুটা এখানেই। লবণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ফলে আবহাওয়ায় বড় রকমের পরিবর্তন ঘটে। বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলে জলজ প্রাণীদের অস্তিত্ব সংকট লক্ষ্য করা যায়। ঝড়-তুফানের পরিমাণ বেড়ে যায় বহুগুণে। এছাড়াও বিভিন্ন গবেষণাগারের রাসায়নিক বর্জ্য, বিষাক্ত কীটনাশক, শিল্প-কারখানার বর্জ্য আরল সাগরের জলে নিষ্কাশন করা হতো। ১৯৬০ সালের বিশাল হ্রদের জল দ্রুত শুকিয়ে যেতে থাকে। স্থানীয় অধিবাসীরা বিষয়টি লক্ষ্য করে। আরলের জলের উপর নির্ভরশীল অধিবাসীরা উপায় না দেখে অন্য প্রদেশে চলে যেতে থাকে। শুধু এই আরল সাগরের প্রতিকুল জলবায়ুর প্রভাব থেকে বাঁচতে আরল সাগর এলাকা থেকে মধ্য এশিয়ার সবথেকে বড় প্রব্রজন ঘটে। ১৯৯৭ সালের শুরুর দিকে করা জরিপ অনুযায়ী এবং সাম্প্রতিক অতীতের গুগল আর্থ প্রদত্ত ছবি থেকে দেখা যায় আরল সাগরের প্রায় ৯৫ শতাংশ জল শুকিয়ে গেছে। অর্থাৎ এক সময়ের বিশাল আরল সাগর কালের করাল গ্রাসে সামান্য জলাশয়ে পরিণত হয়ে যায়।
আরল সাগর বিপর্যয়ের প্রভাবঃ
আরল সাগর বিপর্যয়কে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ধরা হয়। আরল সাগর শুকিয়ে যাওয়ার কারণে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আরল সাগর এলাকার অধিবাসীরা। কারণ তাদের অধিকাংশ নাগরিকের আয়ের প্রধান উৎস ছিল এই হ্রদটি। তাই সাধারণ জনগণের আর্থ-সামাজিক কাঠামো ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। জল শুকিয়ে গেলেও লবণ থেকে যায়। বিপর্যয়ের কারণে পূর্বের আরল সাগর উপকূলে ঘন লবণের স্তূপের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সেখানকার মাটির গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। লবণাক্ত পরিবেশ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ফলে বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগ মহামারী হিসেবে দেখা দেয়। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ৫০ বছরের মাথায় আরল সাগরে লবণের ঘনত্ব বেড়ে লিটারপ্রতি গড়ে ১০০ গ্রাম হয়ে যায়।
১৯৯০ সালের দিকে আরল সাগর এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। আরল সাগরতীরে গড়ে ওঠা মৎস্যশিল্পের চূড়ান্ত পতন ঘটে। পরিবেশবিদরা আরল সাগরের পরিণতি দেখে চিন্তায় পড়ে যান। বিশ্ব উষ্ণায়নের হুমকির সাথে লড়াই করতে থাকা মানবজাতির জন্য আরল সাগর বিপর্যয় এক অপূরণীয় ক্ষতি। আগামী পৃথিবীকে সুস্থ ও সুস্থির পরিবেশ প্রদান করতে শুধুমাত্র মানুষের হস্তক্ষেপে আরল সাগরের বিনাশ আমাদের কাছে একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে।
জলবায়ুর উপর প্রভাবঃ
সাধারন অবস্থায় আরল সাগরের মোট জলের এক পঞ্চমাংশ আসতো বৃষ্টির জল থেকে এবং বাকিটা আসতো সিরদরিয়া ও আমুদরিয়া নদী থেকে। বাষ্পীভবনের পরিমাণের সাথে সাথে এই জলের পরিমাণে একটা সাম্যতা বজায় ছিল। কিন্তু নদীদ্বয়ের জলের নিয়ন্ত্রনের ফলে আরলের জল শুকিয়ে যায় ও সাথে সাথে লবনীভবন প্রক্রিয়ায় এলাকায় লবণের সমাহার ঘটতে থাকে। ১৯৯৮ সালে দেখা যায় এই আরল সাগরের জলতল প্রায় ২০ মিটার নিচে নেমে যায় অর্থাৎ ১৯৬০ সালের ১০৬০ ঘনকিমি জল থেকে ২১০ ঘনকিমিতে নেমে যায়। প্রথমদিকে এই জলতল বছরে ২১ সেমি করে নামলেও পরে টা বেড়ে ৫৭ সেমি প্রতি বছর হয়ে দাঁড়ায় এবং শেষের দিকে তা ত্বরান্বিত হতে থাকে। ফলে জলের পরিমাণের সাথে সাথে আরলের জলের পৃষ্ঠীয় ক্ষেত্রফল কমে যায় এবং অল্প তাপমাত্রায় আরলের স্বল্প জল উষ্ণ হয়ে পড়ে। এতে বাতাসের আর্দ্রতা কমে বাষ্পীভবনের মাত্রা বাড়িয়ে চক্রাকারে পূর্বের জলবায়ু থেকে বিপরীত পর্যায় তৈরি করে। তাহলে আমরা দেখতে পেলাম আরল সাগরের উপর মানুষের হস্তক্ষেপের কারনে আরল সাগরের জলসঙ্কট, লবণের পরিমাণ বৃদ্ধি, এলাকার আবহাওয়াতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, আপেক্ষিক আর্দ্রতা বৃদ্ধি, বাষ্পীভবনের মাত্রা বৃদ্ধি, জল এবং হ্রদের লবণের মধ্যে নেতিবাচক সম্পর্ক, মরুকরণ, ভুমির গুণগত মানের অবনমন, মৃত্তিকায় লবণের পরিমাণ বৃদ্ধি, ধুলি ঝড়, কৃষিকাজের ক্ষতি, জনবসতির অনুকুল পরিবেশ হারিয়ে যাওয়া ইত্যাদি ঘটনা ঘটতে থাকে। আরল সাগর সংহারের পূর্বে আরল সাগর এই অঞ্চলের দিকে আগত শীতকালে সাইবেরিয়া থেকে আগত শীতল বাতাসকে মনোরম করতো যেমন তেমনি গরমের সময় এলাকার আবহাওয়া আরামপ্রদ করে রাখত। পরবর্তীকালে শুধু আরল সাগরের এলাকা নয় সমগ্র মধ্য এশিয়ার জলবায়ু কমবেশি প্রভাবিত হওয়ায় পরিবেশবিদরা একে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলতে নারাজ। বিজ্ঞানীদের মতে আরল সাগর হারিয়ে যাওয়ায় এখানকার জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব পড়ে ৫০%-৬৬% পর্যন্ত। সে বায়ুচাপ, ঋতুগত বৈষম্য, তাপমাত্রা বৃদ্ধি যাই হোক না কেন। একটি গবেষণায় দেখা যায় ১৯৬০-২০০০ সাল পর্যন্ত তাপমাত্রা ২°-৬° সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত বাড়ে। ১৯৫০ থেকে ১৯৮৮ সালের মধ্যে জনসংখ্যা ১৩.৮ থেকে ৩৩.২ মিলিয়নে অতি দ্রুতগতিতে পৌঁছায়। কিন্তু আরলের মৃত্যুর সাথে সাথেই শুরু হয় প্রব্রজন। প্রভাব পড়ে আঞ্চলিক জীববৈচিত্রের উপর, অধিবাসীদের স্বাস্থের উপর, বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাবে আরলের চারপাশে এক পরিবেশগত অস্থিরতা লক্ষ্য করা যায়।
সমস্যা থেকে মুক্তির প্রচেষ্টাঃ
১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটলে আরল সাগর নব্য রাষ্ট্র কাজাখস্তান এবং উজবেকিস্তানের অধীনে চলে আসে। কিন্তু সাগর বা হ্রদ বলতে আমরা যা বুঝি, তার কোনো অস্তিত্ব তখন নেই। মাত্র ৫ শতাংশ অঞ্চল জুড়ে জল অবশিষ্ট ছিল। কিন্তু আরল সাগরের বিপর্যয়ের কারণে পুরো অঞ্চলের আবহাওয়ার উপর প্রভাব ফেলেছে এবং আগামীদিনে যাতে তার কোন কুপ্রভাব না ফেলতে পারে, সেকথা মাথায় রেখে দুই দেশের নেতারা একত্রিত হন। তারা বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প হাতে নেন। লম্বা খাল খনন করে দক্ষিণে সাগর থেকে জল আনার প্রচেষ্টা করা হয়। কিন্তু প্রযুক্তিগত ত্রুটি এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে দেশের বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়। শেষ পর্যন্ত পুরো প্রকল্প বাতিল করে দেওয়া হয়। এরপর ২০০৩ সালে কাজাখস্তান সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পুনরায় নদীর জল আরলের দিকে প্রবাহিত করা হবে। কিন্তু উজবেকিস্তানের সাথে প্রকল্পের বিভিন্ন ইস্যুতে একমত হতে না পারায় পুরো আরল জুড়ে বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প স্থগিত করা হয়। তবে কাজাখ সরকার বসে না থেকে নিজস্ব অর্থায়নে পৃথকভাবে কাজাখস্তান সীমানায় বাঁধ নির্মাণ শুরু করার নির্দেশ দেন। ২০০৫ সালের দিকে বাঁধ নির্মাণ শেষ হয়। বাঁধের কারণে কাজাখ অঞ্চলে আরল সাগরের পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়। হ্রদে জলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং উত্তর আরল সাগরে মাছ চাষ শুরু হয়।
কাজাখস্তানের এই সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে উজবেকিস্তানের বিজ্ঞানীরাও এগিয়ে আসেন। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথে সাথে নবগঠিত দুই রাষ্ট্র কাজাখস্তান এবং উজবেকিস্তানের মধ্যে সীমানা সংক্রান্ত অধিকার নিয়ে সাম্রাজ্যবাদ শক্তি মাথা চাড়া দেয়। এবং নদী বা হ্রদের জলের অধিকার সংক্রান্ত আলোচনায় কেউই সমঝোতায় আসতে না পারায় এই প্রকল্প বেশিদূর এগোয়নি। পরবর্তীতে বিশ্বব্যাঙ্ক উদ্যোগ নিয়ে এই কাজে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। কাজাখ সরকারকে ৬৫ মিলিয়ন ডলার ঋণ প্রদান করা ছাড়াও প্রায় ৮৬ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্প হাতে নেয় বিশ্বব্যাংক। ২০০৮ সালে দ্বিতীয় বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পুনরায় উত্তর আরল সাগরে জল প্রবাহ শুরু হয়। কাজাখস্তান বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে জল পুনরায় আনতে সক্ষম হলেও, গবেষকদের মতে, আর কখনোই আরল সাগরের জল সম্পূর্ণরূপে ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে না। তাছাড়া প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো সমঝোতায় না পৌঁছলে আরল সাগরের বাকি অঞ্চলে কাজ শুরু করা সম্ভব হয় না।
জাতি সঙ্ঘের আবেদনঃ
অনেক প্রচেষ্টার পরেও যখন দুই দেশের রাজনৈতিক তর্জা আর জেদাজেদির কারনে যখন আরল সাগরকে রক্ষা বা উদ্ধার করা দুটোই অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন কাজাখস্থান ও উজবেকিস্থানের কর্মকর্তাদের মাথায় হাত পড়ে যায়। বিশ্বের বিভিন্ন পরিবেশ বৈঠকে আরল সাগরের প্রসঙ্গ আলোচিত হতে থাকে। দীর্ঘ চার পাঁচ দশক ধরে আরল সাগরের তিল তিল করে বিনাশের পরে যখন বিশালাকার হ্রদ কেবলমাত্র একটি ছোট্ট জলাশয়ের রূপ নিয়েছে, কিংবা যত্রতত্র মাছ ধরবার জাহাজ বা লঞ্চগুলি শুষ্ক লবণের স্তুপের উপর অবস্থান করে পূর্বের প্রাণচঞ্চল আরল সাগরের মৎস্যচারনক্ষেত্রের অস্তিত্ব তুলে ধরছে, ঠিক সেই সময় অর্থাৎ ২০১০ সালে তৎকালীন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন মধ্য এশিয়া সফর করতে এসে আরল সাগর অঞ্চলে ভ্রমণ করেন। তিনি আরল সাগরের বর্তমান ভয়াবহ পরিণতি দেখে বিস্মিত হয়ে যান। এর সুন্দর ইতিহাসের সঙ্গে বর্তমান প্রেক্ষাপট তুলনা করতে গিয়ে তিনি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এদিকে ওদিকে ডুবে যাওয়া জাহাজের ধ্বংসাবশেষ ব্যতীত অন্য কোনো চিহ্ন অবশিষ্ট নেই, যা আরল সাগরের অস্তিত্ব প্রমাণ করে। তিনি সমগ্র জাতির উদ্দেশ্যে আহ্বান করে বলেন- “আমি স্তব্ধ! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। এটা আমার দেখা সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আঞ্চলিক নেতাদের আহ্বান করছি। আপনারা আলোচনায় বসুন। আরল সাগরকে রক্ষা করুন”।জাতিসংঘ মহাসচিবের আহ্বান থেকেই অনুমান করা যায় আরল সাগর বিপর্যয় শতাব্দীর সেরা বিপর্যয়।
আরল সাগরের ভবিষ্যৎঃ
পরিবেশবিদদের মতে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে জলকে ঘিরে। বর্তমানে জল অতি মূল্যবান সম্পদ। একথা সত্য যে, কোন সভ্যতা বা জাতির বিকাশে জল বা নদীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। ইতিহাস বলে, প্রাচীন কাল থেকে সকল সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে কোন না কোন নদী তীরবর্তী এলাকায়। তাই জলের প্রয়োজন ছিল, আছে, থাকবে। তাই বলে জল নিয়ে যুদ্ধ প্রসঙ্গে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত ভূগোলের অধ্যাপক তথা আন্তর্জাতিক পরিবেশবিদ অধ্যাপক মলয় মুখোপাধ্যায় এর কথায়, “জল নিয়ে যুদ্ধ করার কোন কারন দেখছি না। কারন আমরা জানি যে পৃথিবীর তিন ভাগ জল একভাগ স্থল। তারপর সেই জলের অভাবে এই বিশ্বে অশান্তি করার কোন যুক্তি নেই। আমাদের সময়ের সাথে সাথে প্রযুক্তিরও বিকাশ ঘটছে। সেই প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটিয়ে, বিজ্ঞানের কৌশল কাজে লাগিয়ে নদী, সাগরের জলকে পরিশোধন করে পানীয় জল বা চাষের জন্য উপযুক্ত করে তুলতে হবে”। তেমনিভাবে আরলের জলকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বড় অর্থনৈতিক শিল্প। তাই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মধ্য এশিয়া এবং ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বড় হ্রদগুলোর জল বিপক্ষ রাষ্ট্রের নিশানায় পরিণত হবে। এক্ষেত্রে আরল সাগরের জল মধ্য এশিয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে। এছাড়াও উজবেকিস্তানের অসম্মতির কারণে এখনও অর্ধেক আরল সাগরের জল সঞ্চালনের কাজ শুরু করে সম্ভব হয়নি। তাই পুনরায় কাজাখ অঞ্চলে আরল সাগর শুকিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু আপাতত আশার বাণী হিসেবে বিশ্বব্যাংক এবং কাজাখস্তানের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে। ফলে পুনরায় আরল সাগরে মৎস্যশিল্প গড়ে উঠছে।
আগামী পৃথিবীর জন্য আরল সাগরের আর্তনাদঃ
আমাদের উন্নত বিশ্বের অনাচারের কারনে প্রাকৃতিক যে বৈষম্য ঘটে, পরিবেশের যে কুপ্রভাব পড়ে কিংবা মানবসভ্যতার উপর প্রকৃতির যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেমে আসে তার বেশী প্রভাব পড়ে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের মানুষের উপর। ফলে বিশ্ব জুড়ে পরিবেশবিদ ও রাষ্ট্রনেতারা আলোচনায় বসে থাকে। এই সকল সম্মেলনে আগামী পৃথিবীর জন্য সঠিক মার্গ উন্মোচন করা হয়। কিন্তু, সেই নিয়ম নীতি অনেকটা খাতায় কলমে থেকে যায় আর তার দায় বর্তায় বিশ্বের পিছিয়ে পড়া দেশগুলির উপর। তাই আরল সাগর বিপর্যয় বর্তমান পৃথিবীর কাছে ছুঁড়ে দেওয়া একটি সতর্কবার্তা। স্বার্থপর মানুষের ভুল পদক্ষেপের ফলে পুরো পৃথিবীর বৃহত্তম হ্রদগুলির মধ্যে একটি হ্রদ শুকিয়ে বিলীন হয়ে গেছে পৃথিবীর বুক থেকে। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে আরল সাগরকে স্বল্প পরিসরে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলেও, পুরো প্রকল্পের জন্য ব্যয় হওয়া অর্থের পরিমাণ বিপুল। জলের অপর নাম জীবন। স্বার্থান্ধ মানুষের ভুল সিদ্ধান্তের দরুন হয়তো এভাবেই সকল জল শুকিয়ে যাবে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলি একসাথে কাজ না করলে ধীরে ধীরে পুরো পৃথিবী ধ্বংসের দিকে ধাবিত হবে। এজন্য বিজ্ঞানীরা ও পরিবেশবিদরা মনে করেন, এই বিশ্বকে বাঁচাতে হলে আমাদের উচিত পরিবেশবান্ধব প্রকল্প হাতে নিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে চলা। জাতিসংঘ, ইউনেস্কো, বিশ্বব্যাংক এই লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। তারা তাদের লক্ষ্য অর্জনে সফল হবে, নাকি নতুন এক আরল অপেক্ষা করছে অদূর ভবিষ্যতে, তা সময়ই আমাদের জানিয়ে দেবে। কারন, মানুষ প্রকৃতি সম্পর্ক একে অপরের পরিপূরক। মানুষের কারনে প্রকৃতির সমগ্র উপাদানকে প্রাকৃতিক নিয়মে চলতে দিতে হয়। মানুষ যখন নিজের কারনে তার পরিবর্তন ঘটাতে চেয়েছে, তার কুফল মানব সভ্যতার উপর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন হয়ে ফিরে এসেছে। তাই আমাদেরকে সাবধান হতে হবে। পরিশেষে বলি, এই লেখা লিখতে গিয়ে যাঁদের লেখা, পুস্তক, গবেষণাপত্র, ইন্টারনেট বা বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সহায়তা পেয়েছি সবাইয়ের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা রইল।
------------------
রচনাকাল : ১৫/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।