সুন্দরবনের বনবিবিঃ এক লোকায়ত সংস্কৃতি
আনুমানিক পঠন সময় : ১১ মিনিট

লেখক : সনৎকুমার পুরকাইত
দেশ : India , শহর : ডায়মন্ডহারবার

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , জুন
প্রকাশিত ৯৭ টি লেখনী ৪০ টি দেশ ব্যাপী ৩৭৪২২ জন পড়েছেন।
Sanat Kumar Purkait
  চব্বিশ পরগণা জেলাদ্বয়ের সুন্দরবনে তথা সমগ্র বাংলার সুন্দরবনের সাথে এই বনবিবি দেবীর নামে যুগে যুগে আলোচিত হয়ে আসছে। এখানকার লোকায়ত সংস্কৃতিতে এই দেবীর আধিপত্য একচ্ছত্র। শোনা যায় সুদুর আরব থেকে এই দেবীর আগমন। সেই কারনে সুন্দরবনকে ‘আঠারো ভাটির দেশ’ বলা হয়। এরূপ নামকরণের কারন আরব থেকে সুন্দরবনে আসতে গেলে তখন আঠারোটি জোয়ারি নদী পেরিয়ে আসতে হত। বনচারী মানুষের কাছে একমাত্র দেবী হিসাবে আজও পূজিত হন বনবিবি বা বনদুর্গা। বনবিবি জঙ্গলের দেবী। জঙ্গলে আসা দরিদ্র মানুষের রক্ষাকর্ত্রী। আমরা বনবিবির মন্দিরে চোখ রাখলে দেখতে পাই, একদিকে দক্ষিণ রায়, মাঝে বনবিবিসহ শাহ্‌জঙ্গলি ও কোন কোন স্থানে দুখের মূর্তি থাকে।  আমরা আজকের আলোচনায় একে একে জেনে নেব কে এই বনবিবি বা বনদুর্গা। দক্ষিণ রায় বা দুখে বা কে? যখন ধর্ম নিয়ে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ বিদ্যমান, সেখানে আঠারো ভাটির দেশে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এই বনবিবির পূজা করতে ব্যস্ত। তাছাড়া ইসলাম ধর্মে যেখানে মূর্তি পূজায় বিশ্বাস নেই, তারাও কেন এই দেবীর পূজায় নিমগ্ন থাকে। কেন মুসলিমের বিবিমাতা হিন্দুর পুজার বিগ্রহ হয়ে উঠল?
  
  প্রথমে জেনে নেব কে এই বনবিবি বা বনদুর্গা? কি তার মহিমা? বনদেবী, বনবিবি, বনদুর্গা, ব্যাঘ্রদেবী আরও অসংখ্য নামে পরিচিত তিনি। হিন্দুদের কাছে তিনি দেবী, মুসলমানদের কাছে পিরানী। তাকে বলা হয় সুন্দরবনের ‘গার্ডিয়ান স্পিরিট’ বা রক্ষাকারী শক্তি। মৌয়াল বা মধু সংগ্রাহক, কাঠুরে, বাওয়াল, জেলে সম্প্রদায়ের কাছে তিনি পরম আস্থার প্রতীক। সুন্দরবনের ৬০-৪০ ভাগ অংশ যথাক্রমে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত, দুই অঞ্চলের মানুষের কাছেই সমান জনপ্রিয় বনবিবি। দক্ষিণবঙ্গের আবহমান সংস্কৃতির সাথে মিশে থাকা বনবিবিকে স্মরণ করে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় ‘মা বনবিবির পূজা’। 

  প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ সতীশ চন্দ্র মিত্রের ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাস’ বই থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, রাজা দক্ষিণ রায়, বণিক ধোনাই ও মোনাই এবং গাজী পীর প্রায় একই সময়ে বিরাজমান ছিলেন। ১৫০০ সালের কাছাকাছি সময়ে আরব এক ফকির পরিবারে জন্ম নেন বনবিবি। তার বাবার নাম ইব্রাহীম, মতান্তরে বেরাহিম, মায়ের নাম গুলান বিবি। কথিত আছে, ইব্রাহীমের প্রথম স্ত্রী ফুলবিবির কোনো সন্তান না হওয়ায় চিন্তিত ছিলেন তারা। পরবর্তীতে ফুলবিবির অনুমতি নিয়ে গুলানবিবি মতান্তরে গোলালবিবিকে বিয়ে করেন ইব্রাহীম। তবে শর্ত ছিল, ভবিষ্যতে ফুলবিবির একটি মনোবাসনা অবশ্যই তাকে পূরণ করতে হবে।

  গুলানবিবি গর্ভধারণ করলে ফুলবিবি হিংসায় কাতর হয়ে পড়ে। তার সেই জমিয়ে রাখা ইচ্ছে পূরণের শর্ত এবার সে আদায় করে নেয় গুলানবিবিকে সুন্দরবনের জঙ্গলে নির্বাসনে পাঠিয়ে। তার কিছুদিনের মধ্যে সেই জঙ্গলেই গুলানবিবির ঘর আলো করে জন্ম নেয় দুই সন্তান বনবিবি ও শাহ্‌ জঙ্গলি। শাহ জঙ্গলি বনবিবির ছোটভাই নাকি যমজ ভাই, তা নিশ্চিত করে জানা যায় না। তাদের দেখাশোনার জন্য নাকি স্বর্গ থেকে পাঠানো হয়েছিল চার দাসীকে। বনবিবি সেখানে বড় হয় এক মাদী হরিণের কাছে। সাত বছর পর নিজের ভুল বুঝতে পেরে গুলানবিবিকে দুই শিশু সন্তানসহ মক্কাতে ফিরিয়ে নিতে আসেন ইব্রাহীম। কিন্তু বাবার সাথে সুন্দরবন ছেড়ে মক্কায় যেতে অস্বীকৃতি জানায় বনবিবি। সুন্দরবনের মানুষ ও পশুদের সাথে তার এমন হৃদ্যতা তৈরি হয়েছিল যে, তাদের ছেড়ে বাবার হাত থেকে চলে যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব ছিল। বোনের টানে বনবিবির সাথেই জঙ্গলে রয়ে যায় শাহ জঙ্গলি।

  অন্য একটি গল্পে বলা হয়, ফুলবিবির যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে মক্কা থেকে সুন্দরবনে চলে আসেন ইব্রাহীম-গুলানবিবি দম্পতি। এখানেই জন্ম হয় বনবিবি ও শাহ জঙ্গলী দুই ভাইবোনের। এই দুই সন্তানের জন্মের পরে সুন্দরবন এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে ইব্রাহীম পরিবার। ‘বনবিবির কেরামতি’ বা ‘বনবিবির জহুরনামা’ নামক গ্রন্থে বনবিবির এমনি আরও অসংখ্য গল্পের কথা বর্ণিত আছে। বলা হয়, একবার মসজিদে খেলতে গিয়ে বনবিবি ও শাহ জঙ্গলি খুঁজে পায় দুটি জাদুর টুপি। এই জাদুর টুপিতে চেপে তারা ঘুরে বেড়ায় হিন্দুস্তানের আঠারো ভাটির দেশে। অন্য একটি মতানুসারে হযরত জিব্রাঈল (আ.) তাদের আঠারোটি দেশ ঘুরিয়ে দেখান। হিন্দুস্তানে পৌঁছে আযান দেন শাহ জঙ্গলি।
প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী দেবী বনবিবির একমাত্র চরম প্রতিদ্বন্দ্বী দক্ষিণ রায় নামে এক ব্রাহ্মন মুনি যিনি এই গভীর জঙ্গলে বসবাস করেন এবং ক্রোধবশতঃ তিনি মানুষ খেতে ইচ্ছা করেন। সেইসুত্রে তিনি বাঘের ছদ্মবেশ ধারন করে বনে ঘুরে বেড়ান যাতে জঙ্গলের কোন সম্পদ মানুষ না নিয়ে যেতে পারে। আর কেউ যদি লুকিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, তাকে দক্ষিণ রায় তার জীবনকে কর হিসাবে গ্রহণ করে থাকে। মতান্তরে, এই দক্ষিণ রায় ছিলেন একজন বিখ্যাত জমিদার যিনি এই আঠারো ভাটির দেশের সমগ্র ম্যানগ্রোভ সাম্রাজ্যসহ সকল সম্পত্তির মালিক আর এই বনের সকল বাঘ তার প্রজা। অহংকারে জমিদার মানুষখেকো রাক্ষসে পরিণত হয় এবং বাঘের আক্রমণে মানুষের মাঝে দক্ষিণ রায় এক সন্ত্রাস হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে যে মধুর সম্পর্ক ছিল তা ভেঙ্গে পড়ে। 

  অসহায় মানুষের আর্তনাদে আল্লাহ্‌ এই নৈরাজ্য ঠেকাতে এক বনবাসী তরুণী কন্যাকে বনের কর্তৃত্ব প্রদান করে তাকে বনবিবি করেন। প্রকৃতপক্ষে এই বনবিবি এবং তার যমজ ভাই শাহ জঙ্গলি শিশুকালে তার পিতামাতা কর্তৃক পরিত্যক্ত হয় বনের মধ্যে এবং এক হরিণ তাকে লালন পালন করছিল। একটা বিষয় লক্ষণীয়, দুজনের নামের সাথে প্রকৃতি (বন ও জঙ্গল) জড়িয়ে আছে। আল্লাহ্‌ এর স্বপ্নাদেশে দুই ভাইবোন মা ফতিমার আশীর্বাদ নিতে মদিনায় গমন করে। সেখান থেকে মক্কায় গিয়ে এই সুন্দরবনের জন্য পবিত্র মাটি নিয়ে ফিরে আসে।
 
  বনবিবি ও শাহাজঙ্গুলি যখন সুন্দরবন সংলগ্ন আঠারো ভাটির দেশে পৌঁছান, তখন সেখানকার রাজা ছিল নিষ্ঠুরতার প্রতীক দক্ষিণ রায় বা রায়মণি। শাহ জঙ্গলির সেই আযানের ধ্বনি কানে যায় দক্ষিণ রায়ের। তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে বন্ধু সনাতন রায়কে পাঠায় রাজা। সনাতন এসে দুই ভাইবোনের কথা জানালে দক্ষিণ রায় আল্লাহ্‌ র উপর খেপে গিয়ে বনবিবি ও শাহ জঙ্গলিকে তাড়িয়ে দেবে বলে ঠিক করল। থামালেন তার মা নারায়নী দেবী। তিনি বললেন, একজন মহিলার সাথে একজন পুরুষের যুদ্ধ করা শোভা পায় না। নারায়নীর সাথে বনবিবি আর শাহ্‌ জঙ্গলির সাথে দক্ষিণ রায়ের তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়।  দক্ষিণ রায় নিজে যুদ্ধের ময়দানে যেতে চাইলে তার মা নারায়ণী তাকে থামিয়ে দেয়। নারায়ণী নিজের সৈন্যসামন্ত নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। বনবিবি আর শাহ জঙ্গলির সাথে ছিল অলৌকিক ক্ষমতা, কাজেই দীর্ঘযুদ্ধের পরে হার মানতে বাধ্য হয় নারায়ণী ও তার বাহিনী। তবে দয়াপরবশ হয়ে বনবিবি তার অর্জিত সাম্রাজ্যের অর্ধেকটা দান করে নারায়ণী ও তার পুত্রকে। নারায়ণীর সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে সুন্দরবন অঞ্চলের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেয় বনবিবি, দক্ষিণ রায় রাজত্ব করে জঙ্গলের গহীন কোণে। মাতা বনবিবি জঙ্গলের নৈরাজ্য বিনাশ করে তৃপ্ত হন। কোন কোন স্থানে এই বনবিবির পাশাপাশি তার সই নারায়ণী দেবীর পুজাও হয়ে থাকে।
  
  এদিকে দক্ষিণ রায়ের শান্তি নেই মনে। প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে মরে। এমতাবস্থায়, গ্রামের দরিদ্র দুখে তার বাবা মায়ের সাথে বসবাস করত। তার বাবা একদিন মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারান। সেই থেকে দুখের মা আর তাকে কোথাও যেতে দেয় না। সবসময় যেন চোখে হারায়, কিন্তু দুখে মনখারাপ করে ঘুরে বেড়ায়। তার বাসনা জাগে, সেও নৌকায় চড়ে ঐ দূরে মাছ ধরতে যাবে, কাঠ ও মধু সংগ্রহ করতে যাবে। কিন্তু তার মা তাকে ছাড়তে চায় না। তাই দুখে বায়না করলেও তার মায়ের ভয়ে তাকে কেউ নিয়েও যায় না। মা বনবিবির কথার মাঝে ‘দুখে’র কথা এসে যায়। এই ‘দুখে’ আর কেউ না, তিনি দুঃখের প্রতীক মাত্র। বাঘ যখন দক্ষিণ রায় এর মতো অহংকারী জমিদার এর প্রতিরূপ, দুখে সেখানে সমগ্র মানবজাতির প্রতিনিধি। দুখের পালা শুনলে আমরা এ বিষয়ে বিশদ জানতে পারি। যাইহোক, এই দুখে এক কিশোর ছেলে, সুন্দরবনের প্রান্তিক গ্রামে তার বিধবা মাতার সঙ্গে কষ্ট করে দিনযাপন করছিল। 

  একদিন তার দূর সম্পর্কের কাকা ধোনা (এখানে ‘ধোনা’ কে ধনসম্পদের প্রতীক হিসাবে মানা হয়) তাকে জঙ্গলে গিয়ে মধুসংগ্রহের লোভ দেখায়। তখন মায়ের কান্না ও নিষেধ উপেক্ষা করে দুখে তাদের সাথে চলে। কিন্তু দিনের পর দিন ঘুরে ঘুরে কোথাও কিছু পাওয়া গেল না। একদিন রাত্রে ধোনা যখন নিদ্রার কারনে একটি দ্বীপে নামে তখন প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে থাকা দক্ষিণ রায় তার সাথে দেখা করে বলে যদি সে প্রচুর মধু পেতে চায় তাহলে দুখে কে তার হাতে সমর্পণ করে। তাহলে সে এক নৌকা ভর্তি মধুর ঠিকানা পেয়ে যাবে। প্রথম দিকে রাজি না হলেও পরে ভয়ে ও লোভে পড়ে তাতেই রাজী হয়ে যায়। দক্ষিণ রায় আরও হুমকি দেয় যদি সে তার কথা না রাখে নৌকাসহ সবাইকে জলে ডুবিয়ে মারবে। এই কথা দুখে সব শুনতে পেয়ে তার মায়ের জন্য কাঁদতে থাকে। কথামত, মধু সংগ্রহ করে ধোনা দুখে কে নিয়ে গিয়ে সুন্দরবনের গভীরে কেঁদোখালি দ্বীপে ছেড়ে আসবে, যেখানে দক্ষিণ রায়ের প্রবল অত্যাচার থেকে কেউ রক্ষা পায় না। দুখে গভীর জঙ্গলে যখন বাঘের আক্রমণের কথা ভেবে উপায়ান্তর না দেখে মায়ের কথা ভাবতে থাকে। মনে পড়ে যায় মা তাকে বলেছিল, জঙ্গলে বিপদে পড়লে মা বনবিবিকে স্মরণ করলে তিনিই রক্ষা করেন। দুখে চিৎকার কর কাঁদতে কাঁদতে মনপ্রাণ দিয়ে মা বনবিবিকে একাত্মভাবে স্মরণ করে। তার ডাকে সাড়া দিয়ে মা বনবিবি হাজির হয়ে তাকে আশ্বাস দেন যে, ‘ভয় নেই দুখে, আমি রক্ষা করব তোকে। তুই এগিয়ে যা’।
 
  পরের দিন সকালে ধোনা সবাইকে বলে যে আমাদের আবার কেঁদোখালি দ্বীপে যেতে হবে যেখানে ইতিপূর্বে গিয়ে কিছু পাওয়া যায় নি। তাই ধোনার লোকেরাও যেতে চাইল না। তখন ধোনা আর দক্ষিণ রায়ের মধ্যে যা কথা হয়েছে সব শোনায় ধোনা। প্রথমে রাজি না হলেও ভয়ে দুখের প্রতি ভালোবাসা উবে গেল। নৌকা এগোচ্ছে। দক্ষিণ রায় নৌকাকে অনুসরণ করতে করতে মৌমাছিকে নির্দেশ দেয় যে কেঁদোখালি দ্বীপের সকল গাছে মৌচাক ভরে দিতে। সেইমত ধোনা গিয়ে দেখে অবাক। মনের আনন্দে নৌকার সকল জার মধুতে ভর্তি করে নিল। দক্ষিণ রায় তার প্রতিশ্রুতি মনে করিয়ে দিল আর বলল তোমাদের এই মধু ও চাক থেকে মোম আলাদা করলে বেশী টাকায় বিক্রি হবে। কথিত আছে এইভাবে চাক থেকে মোমকে আলাদা করার শিক্ষা মানুষ শিখেছিল। নৌকা ছাপিয়ে মধু দ্বীপের চারদিকের জলে পড়তে লাগলো। আজও এই দ্বীপের নিকটের জল মধুপানি বা মিষ্টি জল নামে পরিচিত। আনন্দে ভাসতে ভাসতে লোকেরা দুখে কে পাঠাল জঙ্গল থেকে রান্নার শুকনো জ্বালানি কাঠ নিয়ে আসতে। মন না চাইলেও দুখে গভীর বনে প্রবেশ করার সাথে সাথেই ধোনা লোকজন নিয়ে নৌকা নিয়ে স্থানত্যাগ করল। 

  ঠিক এমন সময়ের জন্য দক্ষিণ রায় অপেক্ষা করছিল সারাদিন। দুখের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে খেতে উদ্যত হতে দুখে মিনতি জানায় আর বনবিবিকে স্মরণ করে। মাতা বনবিবি তার ক্রন্দনে এসে হাজির হয় ভাই শাহ্‌ জঙ্গলিকে নিয়ে। মাতা বনবিবি দক্ষিণ রায়কে হত্যা করতে ভাইকে নির্দেশ দিয়ে তার কবল থেকে দুখে কে মুক্ত করে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেয়। এমতাবস্থায়, দক্ষিণ রায় পালিয়ে তার বন্ধু গাজীর কাছে আশ্রয় নিয়ে পরামর্শ চায়। গাজী তাকে মা বনবিবির কাছে ক্ষমাভিক্ষা চাইতে বলায় দক্ষিণ রায় বনবিবির কাছে জীবন ভিক্ষা করে। সবার কাছে তিনি গাজী পীর নামেই খ্যাত। শেষ পর্যন্ত গাজী পীর গিয়ে বুঝিয়ে-শুনিয়ে বনবিবির কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে যে তারা নিষ্ঠুর রাজার কোনো ক্ষতি করবে না। বিনিময়ে গাজী দুখেকে সাত নৌকাভর্তি মূল্যবান সব ধন-রত্ন উপহার দেন। বনবিবির পোষা কুমির সেকোর পিঠে চড়ে গ্রামে ফিরে যায় দুখে। মা তার অসীম করুণায় দক্ষিণ রায়কে নিজ পুত্রগুনে ক্ষমা করে দেন এই শর্তে যে এখন থেকে জঙ্গলের মানুষসহ সকল প্রাণীকে ভ্রাতৃজ্ঞানে দেখতে হবে আর বনের সকল সম্পদে সবার সমান অধিকার থাকবে। 

  মায়ের ভক্তরা সবাই বিশ্বাস করেন যে, প্রয়োজনের তুলনায় সম্পদ সংগ্রহ করে অপচয় বা সঞ্চয় করলে মা বনবিবি বিপদে তাঁদের রক্ষা করেন না। নিজ গ্রামে এসে বনবিবির এই কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করে দুখে। তার কথায় অভিভূত হয়ে সে গ্রাম তো বটেই, পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতেও শুরু হয়ে যায় বনবিবির উপাসনা। ধোনা তার ভুল বুঝতে পেরে মেয়ে চম্পার সাথে দুখের বিয়ে দেয় এবং দুখেকে গ্রামের চৌধুরী বা প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।

  সেই থেকে অদ্যাবধি দেবীর মর্যাদায় সুন্দরবনের মানুষের কাছে সমাদৃত হয়ে আসছেন বনবিবি। প্রতিবছর বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী পহেলা মাঘ, ইংরেজি ১৬ ই জানুয়ারি সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাগুলোতে বসে বনবিবির মেলা, পালিত হয় বনবিবির পূজা। খ্রিস্টীয় ১৮৯৬ সাল থেকে বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ পশ্চিমবঙ্গের বাসন্তী, গোসবাতে বেশ কিছু অঞ্চলে ঘটা করে বনবিবির পূজা করা হয়। এটি আমাদের ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশে পরিণত হয়েছে।

  সাধারণত জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের ডাকে মা সাড়া দেন যদি বনবিবি জহুরনামা শুরু ও শেষের দিকে খানিকটা পাঠ করেন ভক্তিভরে। বাউলির পরামর্শ ছাড়া কেউ জঙ্গলে প্রবেশ করেন না। এই বাউলি হল বাঘজাদুকর যাঁদের কথা বাঘ নাকি শোনে। প্রকৃতপক্ষে এই বাউলি শব্দটি আরবির সুফি সাধুদের বোঝায় যারা মুলত ষষ্ঠদশ শতকে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অঞ্চল উদ্ধার ও ইসলাম ধর্মের প্রচারের কাজে সহায়তা করেন। বর্তমানে বাউলি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যেও দেখা যায়। সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে আজও এই বাউলি বা ইসলামের বিভিন্ন তুকতাক বনচারী মানুষের খুব কাজে লাগে। স্বভাবে এরা খুব বিনয়ী ও ভদ্র, জঙ্গলে যারা কাঠ ও মধু সংগ্রহ করতে যায় তাঁদের প্রতি এরা খুবই দরদী। জঙ্গলের জন্ম প্রকৃতির সাথে মানুষের সাম্যতা আনার জন্য। তাই সুন্দরবনের বনবিবির মন্দিরগুলিতে কোন দরজা প্রায় নেই বললেই চলে। তা সবার জন্য উন্মুক্ত। বাঘেদের এলাকায় ঢোকার আগে যাতে তারা বনবিবির পূজা দিতে পারে, সেজন্য দেবীর মন্দিরগুলি বিশেষ বিশেষ জায়গায় স্থাপন করা আছে।
 
  সুন্দরবন বাসীর বিশ্বাস যদি কেউ জঙ্গলের আইন না মানে, তাহলে তাকে মা বনবিবি তাকে শাস্তি দিয়ে থাকে, কিংবা বনের মাঝে সাপ কিংবা বাঘের হাত থেকে মা তাকে রক্ষা করেন না। কারন জঙ্গলে যা কিছু হয়ে থাকে সবই তার গোচরে থাকে, তার আড়ালে কোন কিছুই করা যায় না। জনৈক বিধবা ফুলমাসির কথায়, এই তো বছর দশেক আগে একদল কাঠুরিয়াকে সাপের ছোবলে মরতে হল, কারন ওরা জঙ্গলের নিয়ম লঙ্ঘন করে দূষিত করছিল। আবার যাত্রাভিনেতা সামসুদ্দিনের কথায়, আমরা যদি জাতপাত নিয়ে রাজনীতি করি তাহলে মায়ের কৃপা থেকে সবাই বঞ্চিত হব। মায়ের কাছে সবাই সন্তান, কোন ভেদাভেদ নয়, সবাই একজাতি। একসাথে পূজা করলে পরে মায়ের সুখ, শান্তি। আরও জানা যায় মা বনবিবি কারোর লোভকে প্রশ্রয় দেন না। যদি কেউ লোভের বশবর্তী হয়ে চাহিদার তুলনায় বেশী সম্পদ সংগ্রহ করে চিরাচরিত নিয়মানুসারে মা তাদেরকে শাস্তি দেন।

  বনবিবি সুন্দরবনের মানুষের আপনার জন। তিনি আর সুন্দরবন ছেড়ে কোনকালেই যাবেন, এমনকি তার পিতা ইব্রাহিম তার পরিত্যক্ত মাতাকে নিয়ে যেতে এলেও না। কারন জঙ্গলের এই কঠিন জীবন ছেড়ে পিতার হাত ধরে মাতা গুলাব বিবি আগের জীবনে ফিরে গেলেও বনবিবি যান নি এই বনবাসী মানুষের স্বার্থে। আল্লাহ্‌ তাকে পাঠিয়েছেন অশুভ শক্তির হাত থেকে আর্তকে রক্ষা করার জন্য। জয় মা বনবিবির জয়। লেখার জন্য যে সকল গ্রন্থ ও ব্যক্তিবর্গ ও তাঁদের রচনা থেকে সহায়তা নেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই। 

রচনাকাল : ১৫/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Australia : 1  Bangladesh : 111  Canada : 20  China : 13  France : 1  Germany : 8  Hungary : 88  India : 719  Ireland : 33  Japan : 10  
Korea, Republic : 2  Malaysia : 1  Romania : 1  Russian Federat : 5  Saudi Arabia : 5  Sweden : 12  Ukraine : 9  United Arab Emi : 1  United Kingdom : 5  United States : 323  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Australia : 1  Bangladesh : 111  Canada : 20  China : 13  
France : 1  Germany : 8  Hungary : 88  India : 719  
Ireland : 33  Japan : 10  Korea, Republic : 2  Malaysia : 1  
Romania : 1  Russian Federat : 5  Saudi Arabia : 5  Sweden : 12  
Ukraine : 9  United Arab Emi : 1  United Kingdom : 5  United States : 323  
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সুন্দরবনের বনবিবিঃ এক লোকায়ত সংস্কৃতি by Sanat Kumar Purkait is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৪৮৬০৮৬
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী