গানে ভুবন ভরিয়ে দেবো
আনুমানিক পঠন সময় : ৫ মিনিট

লেখিকা : অস্মিতা ভাদুরী
দেশ : India , শহর : Konnagar

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , জুন
প্রকাশিত ১৪ টি লেখনী ৩২ টি দেশ ব্যাপী ৮০৯১ জন পড়েছেন।
Asmita Bhadury
#আন্তর্জাতিক সঙ্গীত দিবস

#গানে ভুবন ভরিয়ে দেবো

"ও বাপি দাওনা আরেকটু বাজাই !"
আদুরে মেঘলা তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলল। বাবা বললেন, " না মা, কাল তোর শো, আজ যদি বেশি রাত জাগিস চোখের নিচে কালি পরে যাবে না ? তখন তোর ওই কাজল নয়ন দেখতে যারা আসবে তাদের কি হবে ?"
বাপির কথায় রেগে গিয়ে মেঘলা বলল, " বাপী, যারা আমার গিটার শুনতে আসে শুধু তাদেরকেই আমার দরকার, বাকি ওই চোখ কান নাক তো সবারই থাকে !"
একটু হেসে মেয়ের নতুন গিভসন_লেস_পল মডেলের স্প্যানিশ গিটার আর প্লেকট্রামটা তার হাত থেকে নিয়ে বাক্সে ভরে , ঘরের আলো নিভিয়ে, দরজা টা ভেজিয়ে দিয়ে নিজেদের ঘরে চলে এলেন।
ঘরে কথাদেবী রাতবাতি জ্বালিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন। আওয়াজ পেয়ে তাকিয়ে বললেন ," মেয়ে শুয়েছে ? নাকি এখনো টুংটাং চলছে তার ?"
জয়জিৎ বাবু, গিন্নির পাশে বসে বললেন , " মেয়েটা সত্যি আমার মনের মতো হয়েছে গো কথা, এত পাগল গিটারের জন্য, ওর জীবনটা একদম সাজানো হবে দেখো ।"
টেবিলের ওপর রাখা নিজের হাওয়াইয়ান গিটার টার ওপর হাত বুলিয়ে মুচকি হাসলেন তিনি। তারপর তিনটি আঙুলে প্রিক্স পরে, বার টা হাতে নিয়ে গিটার টা কোলে তুলে নিলেন।
মৃদু মৃদু স্বরে বাজাতে শুরু করলেন সেই আগেকার প্রিয় গানের সুরগুলো। কখনো তাতে বাজলো - ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে, কখনো বাজলো - মোর বীণা ওঠে, কখনো বাজলো - ও কোকিলা তোরে শুধাই রে....দুজনেই ভেসে গেলেন প্রায় পঁচিশ বছর আগের দিনগুলিতে ।

 মেঘলার বাপি মানে জয়জিৎ বাবু যুবা বয়স থেকেই গিটার বাজান। চাকরি করতেন না তখন। তবে ওই অঞ্চলে যেহেতু আর কেউ গিটার বাজাত না, তাই গিটার শিক্ষক হিসেবে বেশ ভালোই নাম পেয়েছিলেন। প্রচুর ছাত্র ছাত্রী হয়েছে। কিছুদিন পরে নিজের একটা গিটার স্কুল ও করেছিলেন। অনেক কষ্ট করেছিলেন সেইসময়। কথা দেবীকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, শুধু মাত্র গিটার শিক্ষকতা  করেই জীবন নির্বাহ করবেন ভেবে । কদিন পরে মেঘলা এলো কোল জুড়ে। তার আসার কয়েকদিন পরেই কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি পান জয়জিৎ বাবু। মেয়ের ভাগ্যেই পেয়েছেন এই বিশ্বাস নিজেদের মধ্যে ছিলই, তাই যেকোনো কাজে মেয়ে কে নিয়ে যেতেন শুরুতেই। 

তো সেবারেও তাই করেছিলেন।গিটার স্কুল এর ক্লাস এতদিন হতো "বড় বসিয়া  হাই স্কুল" এর একটা ঘরে। এত বছরের চেষ্টায় পাশেই একটুকরো জমি কিনে, ছোট্ট করে বানিয়েছেন স্কুল। 
নাম আগেই ছিল তবে কাগজে কলমে, এবার খোদাই হলো বাড়ির সামনের দেওয়ালে, "অনুরণন" । 
এই নাম টা ঠিক করে দিয়েছিলেন কথা দেবী। গিটারের ক্লাস করলে তারের অনুরণন ই শেখার মূল বিষয়। ছয়টা তারের মধ্যে এত সুর ফুটিয়ে তোলাই উদ্দেশ্য। তো সেই লোহার তারের অনুরণন শিখতে গিয়ে, হৃদয়ের তার অনুরণিত হয়ে গিয়েছিল কথাদেবীর। ব্যাস, যার হাত ধরে তারের অনুরণন শেখা, তারই হাত সারা জীবনের জন্য ধরে নিলেন। তাই গিটার স্কুলের নাম নির্বাচনের সময় বেশি ভাবতে হয়নি তাদের। কথাদেবীর প্রস্তাবিত নাম সাদরে গ্রহণ করেছিলেন জয়জিৎ বাবু ।
তা সেটা ছিল ওই অনুরণন এর নিজের বাড়িতে দিন শুরুর শুভদিন। 

জয়জিৎবাবুর অগুনতি ছাত্র ছাত্রীর হৈচৈ, কথাদেবী ও জয়জিৎ বাবুর হাজারো ব্যস্ততা, অতিথিদের আপ্যায়ন এসবের ভিড়ে বছর পাঁচেকের ছোট্ট মেঘলা যে কখন সামনের ছোট মাঠটার টানে বেরিয়ে গেছে কেউ খেয়াল ই করেনি। খেয়াল পড়ল যখন পুজোর শেষে শান্তি জল নেয়ার জন্য কথা দেবী মেয়েকে ডাকলেন। "মেঘা মেঘা" করে বাড়ি, উঠোন, ছাদ সব খুঁজে ফেললেন। নেই সে। 

সব খুশি নিমেষে উড়ে গেল । দাদা বৌদির ওপর অতিথিদের দায়িত্ব দিয়ে জয়জিৎ বাবু আর কথাদেবী ছুটলেন মেয়ের খোঁজে। একটু দূরেই একটা ছোট মাঠ, তার পাশেই আগাছা ভর্তি ছোট ডোবা। কথা দেবী ডোবার দিকেই ছুটলেন। মায়ের মন তো, কুডাক ই দেয় আগে। আশেপাশের কয়েকজন আর জয়জিৎবাবুর কিছু ছাত্র ও সেটাই সন্দেহ করল। দুজন সাথে সাথে নামলো ডোবার জলে, নেই কোথাও কিছুই, কোমর অবধি জল মাত্র, মজে যাওয়া ডোবা একটা। জলভরা চোখে আকুতি নিয়ে আরাধ্যা মা সরস্বতীর উদ্দেশ্যে আকাশে মুখ তুলে প্রার্থনা জানালেন জয়জিৎ বাবু । তখনই চোখে পড়ল একটু দূরে ট্রেন লাইনের পোস্ট এর টাওয়ারের দিকে। মাথা দুলে উঠলো তাঁর। মেয়ের যে রেলগাড়ি ভীষণ প্রিয়। নতুন বাড়ির ছাদ থেকে রেলগাড়ি দেখা যায় দেখে মেয়ের যে কি আনন্দ হয়েছিল ! তবে কি...

আর ভাবতে পারলেন না তিনি, "মেঘা মা" বলে চিৎকার করে দৌড়ে গেলেন রেল লাইনের দিকে। তাকে অনুসরণ করলেন কথাদেবী ও বাকি সবাই। একছুট্টে সেখানে গিয়েই বুক টা ধড়াস করে উঠলো ওনার। ছোট্ট মেঘলা রেলের দুটো ট্র্যাকের মাঝখানে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে ! দৌড়ে গিয়ে কোলে তুলে নিলেন মেয়েকে। মেয়ের মুখে চোখে কোনো ভয় নেই। উজ্জ্বল হাসি মাখিয়ে আধো আধো বোলে কলকল করে বাবার গলা জড়িয়ে বলে উঠলো " জানতো বাপি, লেলগালিল ওই তাল গুলোও না তোমাল ঐ গিটালেল মতো। তেলেন আসাল আগে কি চুন্দর কলে বাজছিল ! " 
বলে আঙ্গুল তুলে ইশারা করল ওপরে ইলেকট্রিক লাইনের তার গুলোর দিকে। 
জয়জিৎবাবু মেয়েকে বুকে চেপে ধরে, কপালে চুমু খেয়ে বললেন, " না মা, আওয়াজ টা তার থেকে হয় না, আওয়াজ টা মাটিতে বসানো এই লাইন থেকে আসে। তা তুই এখানে লাইনের মাঝখানে এসে বসেছিলিস কেন ? ট্রেন এলে যে সর্বনাশ হতো মা ?"
মিষ্টি হেসে মেঘলা বলল, " আমি কি বোকা নাকি, আমি ঐ দুলে দালিয়ে তিলাম, টেলেন চলে যাবার পলে আওয়াজ তা ছুনব বলেই তো এতানে এছে বছলাম ! "
বাপ মেয়ের ওই কথপোকথনে উপস্থিত সবাই হেসে উঠলো। কথাদেবী মেয়ের কান টা ধরে আলতো করে টান দিয়ে বললেন , "বলেছিলাম না একা কোথাও যেতে নেই, ছেলেধরা ধরে নিয়ে যায় !"
মেঘলা বলল " বাপি দেতো মা না তিচ্ছু জানেনা, আমি কি ছেলে নাতি যে ছেলেধলা ধলবে !?"
মেয়েকে কোলে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন সকলে।

তা সেই ঘটনার পর থেকে কেটে গেছে প্রায় কুড়িটা বছর। বয়স হয়েছে জয়জিৎবাবুর, কদিন পরেই অবসর নেবেন। কথাদেবীও অসুস্থ শরীর নিয়ে সংসার চালান। একদিন ট্রেনের যাওয়া আসার আওয়াজে গিটারের মতো শব্দ খুঁজে পেয়েছিল যে মেঘলা, সে এখন বিখ্যাত গিটার আর্টিস্ট। অনেক নামি দামি জায়গায় বাজায় সে। মেয়েদের নিয়ে একটা ব্যান্ড ও খুলেছে সে, নাম দিয়েছে
"beats, that can be felt in veins only "

অনুরণনেরই আধুনিক আর পাশ্চাত্য ছায়া !!

রচনাকাল : ১৫/৬/২০২০
© কিশলয় এবং অস্মিতা ভাদুরী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 3  China : 8  Europe : 1  France : 3  Germany : 1  India : 94  Ireland : 8  Russian Federat : 5  Saudi Arabia : 8  Sweden : 12  
Ukraine : 7  United States : 104  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 3  China : 8  Europe : 1  France : 3  
Germany : 1  India : 94  Ireland : 8  Russian Federat : 5  
Saudi Arabia : 8  Sweden : 12  Ukraine : 7  United States : 104  
লেখিকা পরিচিতি -
                          ১৯৯১ সালের ১১ই জানুয়ারি হাওড়া জেলার অখ্যাত গ্রাম হিরাপুরে জন্মগ্রহণ করেন অস্মিতা। বর্তমানে কোন্নগরবাসী এই লেখিকার, ছোট থেকেই লেখা লিখির প্রতি ঝোঁক ছিল। মূলত মা কে দেখেই অনুপ্রেরণা পান লেখিকা। পেশায় শিক্ষিকা হলেও শখ বলতে নিজের ছোট্ট বাগানের ও পোষ্যদের পরিচর্যার পাশাপাশি গান শুনতে ভীষন ভালোবাসেন। বেড়ানো, ছবিতোলা, নাচের কোরিওগ্রাফ করা শখের মধ্যেই পড়ে। কলম যেহেতু তলোয়ারের চেয়েও  শক্তিশালী, তাই নিজের বলতে না পারা সব কিছুর প্রতিবাদ লেখা দিয়েই করেন। 

ভালো থাকায় ও ভালো রাখায় বিশ্বাসী হয়ে, পরিচিত অক্ষর ও শব্দ দিয়েই , নতুন গল্পমালার সৃষ্টি করেন ! 
                          
© কিশলয় এবং অস্মিতা ভাদুরী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
গানে ভুবন ভরিয়ে দেবো by Asmita Bhadury is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫৪১৫৭১
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী