একটু আগে পর্যন্ত ঘুরে বেড়াচ্ছিল, দৌড়ে এ ধার থেকে ওধারে ছুটছিল। অকস্মাৎ কিসের একটা আওয়াজ হল। তারপর আর সে নেই। ভাবতে অবাক লাগছে এই ছিল, এই নেই। তখনও পর্যন্ত বাড়ির সবাই জানে না। জানানো হয় নি তখনও। কি করে জানাবে ভেবে পাচ্ছে না তুলিকা। একটু আগে তার চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, এখন আর নেই। ভাবতেই পারছে না তুলিকা। যাইহোক, সবাই যে যার কাজে গেছে। এখন আর জানানোর দরকার নেই বলে নিচে চলে গেল তুলিকা। কিন্তু, একটা বিষয়ে তুলিকার খটকা লাগছে। তাই মনে মনে অস্থির হয়ে উঠছে।
সেখানে গিয়ে আরামকেদারায় বসে ভাবতে ভাবতে বিভোর হয়ে গেল। তার ঘোর কাটল ন’কাকুমনি এসে যখন এককাপ গরম গরম চা পাঠাতে বলল। কাকিমার কাছে চা এর কথা বলে তুলিকা দাদুর কাছে গিয়ে মন খারাপ করে বসে আছে। দাদু মন খারাপের কারণ জানতে চাইলে, কিভাবে কখন হল এতকিছু ঘটনা তুলিকা জানালো।
সব শুনে দাদু তুলিকা কে আশ্বস্ত করে বলল।
-তুলিকা, এই দুনিয়ায় যা কিছু ঘটে সব তাঁর ইচ্ছায়। কোনকিছুই আমাদের হাতে নেই রে মা। এই পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে আমরা সবাই নাটকের কুশীলব। তিনিই হলেন নির্দেশক, নির্দেশকের নির্দেশক, মহানির্দেশক। তাই কষ্ট না পেয়ে মেনে নে। মনে রাখবি যা কিছু হচ্ছে সব হওয়ার ছিল বলেই হচ্ছে।
তুলিকা একটু বড় হয়েছে, কিন্তু সেই শৈশবের সরলতা কাটে নি। এতকিছু শোনার পরেও তুলিকার মন উদাস হয়ে রইল। আচ্ছা, দাদুভাই, ওর কি দোষ ছিল, যে অসময়ে চলে যেতে হল, তাও এইভাবে।
- আচ্ছা, দোষ না করলে কি এমনভাবে অকালে পৃথিবী ছাড়তে হয় রে? অপরাধ থাকে এর পিছনে। হয়তো এ জন্মে নয়, আগের কোন জন্মে অপরাধ করেছিল, এজন্মে সাজা পেল। আমি ধ্যানে জেনে নিচ্ছি, ওর কি অপরাধ ছিল। এই বলে ধ্যানে বসলেন অশীতিপর রসিক রামতনু দত্ত। দাদুভাই চোখ বুজে, তুলিকা তাঁর মুখপানে চেয়ে। প্রতীক্ষায় রত কি উত্তর আসে! কোন সেই অজানা কারণে তাকে এত তাড়াতাড়ি এই দুনিয়া ছাড়তে হল। এইসব ভাবতে ভাবতে ঠিক দু’মিনিট পরে দত্তবাবু চোখ মেলে তাকিয়ে বললেন-
-জানতাম, ঠিক এই ধরণের কিছু না কিছু করে বসে আছে। ওর মৃত্যু তো এমন করে হওয়া উচিৎ। নইলে ওর মুক্তি হবে না যে।
এদিকে তুলিকা উৎসুক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইছে, কি করেছিল সে? কোন অপরাধে তাকে চলে যেতে হল? বলো আমাকে।
দাদু গম্ভীর হয়ে বললেন, আজ থেকে অনেক জন্ম আগে অর্থাৎ দ্বাপর যুগে একটি সুন্দর ব্রাহ্মন দুহিতা রাস্তা দিয়ে যখন যমুনা থেকে জল নিয়ে ফিরছিল, তখন তাঁর সাথে ছিল তাঁর পিতা। এমন সময় একটি বালক অন্য খেয়ালে আসতে আসতে ব্রাহ্মন কন্যার সাথে ধাক্কা লাগাতে সে রাস্তায় পড়ে যায় এবং আঘাতপ্রাপ্ত হয়। তাঁর ব্যাথায় ব্যাথিত তাঁর পিতা সেই বালকটিকে অভিশাপ দেন যে, রে বালক, তুই আমার কন্যাকে করিস আঘাত, তুই আর মানুষ কুলে জন্ম নিবি না। তোর জন্ম হবে ঘৃণ্য কীট কুলে।
-প্রভু, আমার কোন দোষ নেই, আমি বুঝতে পারি নি। কৃপা করুন। এমন অভিশাপ দেবেন না। আপনার অভিশাপ ফিরিয়ে নিন। এইসব বলে ব্রাহ্মনের চরণ জড়িয়ে ধরে সেই বালক। এতে ব্রাহ্মন কন্যার মনে করুণা হয়। পিতাকে অনুরোধ করেন অভিশাপ ফিরিয়ে নেবার।
-আমার অভিশাপ প্রত্যাহার করা যায় না। তবে, আগামী কলিযুগে তুই কীটকুলে জন্ম নিয়ে আরশোলা হয়ে জন্মাবি। আমার কন্যার নাম হবে তুলিকা দেবী। তুই যদি কোন অকস্মাৎ আঘাতে প্রাণত্যাগ করে আমার এই কন্যার চরণে পড়িস, তবেই তোর এই অভিশাপ লঙ্ঘন হবে। সেদিন তুই পাবি মানব জন্ম।
সেই অপরাধে ওর এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া, এবার বুঝেছিস তুলি। তুই যার মৃত্যুর কথা ভেবে দুঃখ পাচ্ছিস, আসলে সে তোর ছোঁয়ায় আজ মুক্তি পেল। তাই দুঃখ না করে আনন্দ কর। এ কথা শোনামাত্র বাড়ি মাথায় করল ছোট্ট তুলিকা। সবাই যে যেখানে ছিল দৌড়ে এল। আনন্দে আত্মহারা তুলিকা। রসিক দত্ত বাবু আরাম কেদারায় এসে নিজেকে এলিয়ে দিল। মা কাকিমা সবাই জানতে চাইল, ব্যাপারটা কি?
তুলিকার একটায় উত্তর, ওকে আজ মুক্তি দিলাম। আনন্দে আত্মহারা।
উপায়ান্তর না পেয়ে, সবাই বাড়ির কর্তার স্মরণাপন্ন হলেন। তিনি তখন বলতে শুরু করলেন।
- আজ প্রচণ্ড গরমে আমাদের তুলিকা যখন উপরের ঘরে কম্পিউটারে কাজ করছিল। একটা আরশোলা ওর আশেপাশে ঘুরছিল। সিলিং ফ্যানটা দুরন্ত গতিতে ঘুরছিল। অকস্মাৎ, সেই চলন্ত ফ্যানের ব্লেডে ধাক্কা খেয়ে আরশোলার গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটে। ছিটকে এসে পড়ে তুলিকার পায়ের কাছে। সেটা নিয়ে তুলিকা খুব চিন্তায় ছিল। তাই আমি পূর্বের অভিশাপের কথা স্মরণ করালাম। এখন তাঁর মুক্তি পাওয়ার খবরে ওর আনন্দের সীমা নেই।
পরিণত বয়সের জটিল চিন্তাতে ভরপুর মাথার মানুষ সবাই একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে কেউ হাসাহাসি করল, কেউবা উদাস হয়ে আবার তাঁদের কাজের প্রতি মনোযোগ দিতে গেলেন। কিন্তু শিশুর সারল্য আর অভিজ্ঞতার ভারে জর্জরিত রসিক দত্ত বাবুর আনন্দ বহাল তবিয়তে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি, গল্পের বাঁধন আনতে কিছু কিছু জায়গায় কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়েছে। পাঠকের সরল মনে বিশ্বাস হরণের তাগিদে নয়। সেকারণে ক্ষমাপ্রার্থী। ভালো লাগলে কমেন্ট করতে ভুলবেন না কিন্তু।
রচনাকাল : ১৫/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।