সাহিত্য হল সমাজ জীবনের দর্পণ। মানুষের মনের ভিতরে যে চিন্তাভাবনা বা অনুভূতি প্রথিত থাকে বা সেই অনুভূতি প্রকাশের জন্য মানসিক প্রেষণা কাজ করলেও পরিবেশ পরিস্থিতি যখন অনুকূল থাকে না, তখন তা প্রকট না হয়ে প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকে অধিকাংশক্ষেত্রে। তবে পত্রপত্রিকার মাধ্যমে সেই দর্শন মানুষের মাঝে তুলে ধরা যায় সকল অনুশাসনের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে। তাই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে সমাজে, দেশে, রাষ্ট্রে যত বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে তার পিছনে পত্রপত্রিকায় লেখা বিরাট ভূমিকা পালন করে এসেছে। গ্রাম্য এলাকায় আবার ক্ষুদ্র পত্রপত্রিকার প্রভাব ও প্রচলন বেশি নানা কারণে। তা এই ক্ষুদ্র পত্রপত্রিকা গ্রামীণ উন্নয়নে কতটা ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে সেটা জানার পূর্বে আমাদের এই লিটল ম্যাগাজিন বা ক্ষুদ্র পত্রপত্রিকা বা গ্রাম ও তার উন্নয়ন সম্পর্কে আমাদের কাণ্ডজ্ঞান স্বচ্ছ থাকা একান্ত দরকার।
লিটল ম্যাগাজিন হল আকারে যেমন ক্ষুদ্র, প্রচারে তেমন ক্ষুদ্র, যদিও সবসময় সেই সীমার মধ্যে আবদ্ধ না থেকে মাঝে মাঝে সুদূরপ্রসারী হয় এর প্রচার। যাইহোক, ক্ষেত্রবিশেষে এর প্রভাবও অনেক সুদূরপ্রসারী। এই লিটল ম্যাগাজিন সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রখ্যাত আধুনিক কবি বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘সাহিত্যপত্র’ নামে কবিতা বিষয়ক সাহিত্যপত্রিকার একটি প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘লিটল কেন? আকারে ছোট বলে? প্রচারে ক্ষুদ্র বলে? নাকি বেশীদিন বাঁচে না বলে? সব কটাই সত্য, কিন্তু এগুলোই সব কথা নয়; ওই ‘ছোট’ বিশেষণটাতে আরও অনেকখানি অর্থ পোরা আছে। প্রথমত, কথাটা একটা প্রতিবাদ, একজোড়া মলাটের মধ্যে সবকিছুর আমদানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, বহুলতম প্রচারের ব্যাপকতম মাধ্যমিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। লিটল ম্যাগাজিনঃ বলেই বোঝা গেল যে জনপ্রিয়তার কলঙ্ক একে কখনও ছোঁবে না, নগদ মূল্যে বড়বাজারে বিকোবে না, কিন্তু হয়তো – কোন একদিন এর একটি পুরোনো সংখ্যার জন্য গুণীসমাজের উৎসুকতা জেগে উঠবে, সেটা সম্ভব হবে এই জন্যেই যে, এটি কখনও মন যোগাতে চায়নি, মনকে জাগাতে চেয়েছিল।চেয়েছিল নতুন সুরে কথা বলতে; কোন এক সন্ধিক্ষণে যখন গতানুগতিকতা থেকে অব্যাহতির পথ দেখা যাচ্ছে না, তখন সাহিত্যের ক্লান্ত শিরায় তরুণ রক্ত বইয়ে দিয়েছিল – নিন্দা নির্যাতন বা ধনক্ষয়ে প্রতিহত হয়নি। এই সাহস, নিষ্ঠা, গতির একমুখিতা, সময়ের সেবা না করে সময়কে সৃষ্টি করার চেষ্টা – এইটেই লিটল ম্যাগাজিনের কুলধর্ম’।
অর্থাৎ, লিটল ম্যাগাজিনের যে ব্যাপকতা আর উদ্দেশ্য তা কোন অংশে বাজারের অন্যান্য ব্যবাসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে গড়ে ওঠা তথাকথিত জনপ্রিয় পত্রিকার মত না হলেও তার গুণগত মান যদি ভালো হয়, তাহলে তার গ্রহণযোগ্যতা এবং প্রভাব দুটোই আলোচনার দাবী রাখে। গুণমান নিয়ে কবি বরুণ চক্রবর্তী লেখেন, ‘লিটল ম্যাগাজিন উন্নত চেতনার প্রতীক/লিটল ম্যাগাজিন চিরকাল প্রতিবাদের অনিবার্য হাতিয়ার/লিটল ম্যাগাজিন জীবনের কথা কয় আগুয়ান নিঃসংশয়। (অতন্দ্রপথঃ ২০০৩)
আবার বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও কবি নবকুমার শীল এর মতে, ‘দীর্ঘকাল নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই লিটল ম্যাগাজিনের আত্মপ্রতিষ্ঠা। .........তার সংগ্রামী আপসহীন চেতনার গভীরে আছে দুর্নিবার গতি। নিত্যনতুন আঙ্গিক প্রকরণে জীবনের বহুমুখী দিক উন্মোচনের নিরন্তর অন্বেষা তার প্রাণধর্ম। (লিটল ম্যাগাজিন সংবাদঃ ২০০৩)
এবারে আমরা গ্রাম ও তার উন্নয়নের আলোচনায় যদি আসি দেখতে পাই যে ভারতীয় জনগণনা অনুসারে যেখানে শহরের তুলনায় জনসংখ্যার পরিমাণ কম, এখনও পর্যন্ত আধুনিক সুযোগ সুবিধার অনেক কিছু পৌঁছায় নি, জীবন ও জীবিকার স্বার্থে ৭৫ শতাংশের বেশি মানুষ কৃষিকাজ বা সংশ্লিষ্ট কাজের সাথে যুক্ত সেই অঞ্চলকে গ্রাম বলে ধরে নেওয়া হয়। আর এই গ্রাম বা তার জনগণের উন্নয়ন বলতে বোঝায়, বর্তমান অবস্থা থেকে ভালোর দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা। সাধারণত এই ভালোর সীমানা বা পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় শহর বা নগরের আরথ-সামাজিক চিত্রের সাথে তুলনা করে। আমাদের আজকের আলোচনায় আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক উন্নয়নে ক্ষুদ্র পত্রপত্রিকার ভূমিকা বিশ্লেষণ করা হবে।
সাধারণত, মানুষের চাওয়ার সীমা নেই। সমাজবিজ্ঞানের ধারা অনুসারে মানুষের প্রাথমিক চাহিদা তথা খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের সংস্থান হওয়ার পরে মানুষের গৌণ চাহিদা তৈরি হয়। তার পূর্বে মানুষের মৌলিক চাহিদা প্রধান থাকে। তাই বেশীরভাগ মানুষের বেশি পরিমাণ ভালো করাটাই হল উন্নয়নের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য। সময়ের সাথে সাথে গ্রামীণ উন্নয়নের বিভিন্ন প্রকল্প সরকারী ও বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত হয়েছে। ড্যানিয়েল হ্যামিল্টন সাহেব, মহাত্মা গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ত্র্যহস্পর্শে যে গ্রাম উন্নয়নের ছবি আঁকা শুরু হয়েছিল তা সমবায় সংগঠনের মাধ্যমে সাফল্য এলেও বর্তমানে অনেক নতুন নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হলেও গ্রামীণ মানুষের অজ্ঞতার কারণে তা অনেকেই জানতে পারেন না। আর যারা জানতে পারে, নিজেদের আখেরে লোকসান হবার আশঙ্কায় কাউকে জানান না।
রাজনীতি থেকে সমাজনীতি আর অর্থনীতি থেকে কূটনীতি সবক্ষেত্রেই পত্রপত্রিকার গুরুত্ব যে অপরিসীম তার সাক্ষী সময়। অর্থনীতির প্রাথমিক ক্ষেত্রবিস্তৃত গ্রামীণ এলাকায় এই ক্ষুদ্র পত্রপত্রিকার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের যে শিক্ষা, সংস্কৃতি আর সমাজকল্যাণের ধারার পরিবর্তন ঘটে থাকে। গ্রামের ছাত্র, শিক্ষক বা শিক্ষাব্রতী মানুষের স্বাধীন চিন্তাভাবনা, তাঁদের কৃষ্টি তথা সাহিত্য, প্রবন্ধ, কবিতা বা গল্প, উপন্যাসের একক ও মৌলিক সৃষ্টি সকলের মাঝে তুলে ধরার মাধ্যম হল এই তথাকথিত অনামী ক্ষুদ্রপত্রপত্রিকা। কারণ গ্রামের ছোট ছোট কুশীলব বা অখ্যাত মানুষের প্রতিভা তুলে ধরার জন্য শহরের বড় বড় পত্রিকা সুযোগ প্রদান করে না। বর্তমানে এমন অনেক প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা আছে যারা টাকার বিনিময়ে লেখা ছাপে বা সুপারিশ পেলে ছাপে। কিন্তু প্রতিভার স্ফুরনে তো আর শহর গ্রামে কোন প্রভেদ থাকে না। আজকের যারা প্রতিষ্ঠিত লেখক, তাঁদের প্রায় প্রত্যেকের শুরুটা কিন্তু এই লিটল ম্যাগাজিনের হাতে। তাই সাহিত্য ও সংস্কৃতির সৃজনশীলতার বিকাশে আর তার থেকে নতুন তথ্য ও তত্ত্ব পেতে গ্রাম্য এলাকায় একমাত্র অবলম্বন হল ক্ষুদ্রপত্রিকা।
সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গ্রামের মানুষের আয় কম, তাই তাঁদের বিলাসিতাও স্বাভাবিক নিয়মে কম হলেও বাসনা কিন্তু কোন অংশে কম নয়। তাই আমরা দেখতে পাই, সাধ্যের মধ্যে না থাকলেও সাধ পূর্ণ করতে চায়ের দোকানে, সেলুনে একটা সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন অনেকেই শেয়ার করে পড়ে নেয়। তাই এই ক্ষুদ্র পত্রিকার দাম টাও কম থাকায় অনেকের কাছে পৌঁছে যায়। গ্রামের মানুষের বিনোদন, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির অন্যতম মাধ্যম হিসাবে লিটল ম্যাগাজিন এক বিশেষ উপাদান হয়ে উঠেছে। লিটল ম্যাগাজিনের মধ্যে দিয়ে গ্রামের একেবারে তৃণমূলস্তরের মানুষের চেতনা জাগে, সঠিক মার্গ উন্মোচন হয়। যেমন পঞ্চায়েত বা ব্লকস্তরে যে সকল গ্রামোন্নয়নের যে সকল সরকারী ও বেসরকারী প্রকল্প বর্তমান তা এই লিটল ম্যাগাজিনের মাধ্যমে সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়া অতি সহজ হয়। সেক্ষেত্রে বড় পত্রিকা বা পুস্তকে বিজ্ঞাপনের বেশি খরচ বা মানুষের বেশি দামে ক্রয় করার ক্ষমতার বাইরে থাকার সেগুলো এড়িয়ে যায়। ফলে অজ্ঞাত থাকার কারণে, যাঁদের লুটেপুটে খাওয়ার তারাই খেয়ে চলে, দুর্নীতি বাড়ে। দারিদ্র্য স্বমহিমায় বিরাজ করে, প্রকল্পের নামে গ্রামের উন্নয়ন না হয়ে পিছিয়ে যায়। এভাবে এক বা একাধিক লিটল ম্যাগাজিন দায়িত্ব নিয়ে গ্রামীন উন্নয়নে অর্ধশিক্ষিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে।
শিশু, কিশোর বা পিছিয়ে পড়া সমাজের প্রতিনিধির প্রতিভাধর কুশীলবের প্রতিভার স্ফুরণ হয় এই লিটল ম্যাগাজিনে। ঠিক যেমন প্রায় প্রতিটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি করে পত্রিকা প্রকাশ করা হয়, তেমনিভাবে গ্রামের কোন ক্লাব, সংস্থা বা অনুশীলনকেন্দ্র থেকে যখন এই ধরনের পত্রিকা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ পেতে থাকে, সেই এলাকার উন্নয়ন স্বাভাবিকভাবে হতে থাকে। মানুষের চেতনা, মানসিকতা ও দর্শনের স্তর অনেকটাই উচ্চে অবস্থান করে। তবে পত্রিকা ও পত্রিকার লেখার গুণ ও মান দুটোই ভালো হওয়া দরকার। এমনও অনেক প্রমাণ আছে, বহু পত্রিকার অনেক বছর পূর্বের কোন একটি প্রকাশনা পাওয়ার জন্য অনেক উচ্চ মার্গের লোক এসে গ্রামের বয়স্ক মানুষের সাথে যোগসূত্র তৈরি করেন।
পত্রিকার সমসাময়িক চর্চার হাত ধরে একটা সমাজ তার দেশ (Space) ও কালের (Time) নিরিখে কতটা অগ্রসর হয়েছে বা পশ্চাতে চলে গেছে তা আলোচনা গবেষণার কাজে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পত্রিকা যতই ক্ষুদ্র হোক, সে তো তুচ্ছ নহে, তার মধ্যে অবস্থান করে কোন এক হিরের টুকরো লেখা যা সময়ের হাত ধরে সমাজ ও সভ্যতাকে পরিবর্তনের পক্ষে যথেষ্ট। ছোট্ট বীজের মধ্যে যেমন একটি বনস্পতি লুকিয়ে থাকে, ঠিক তেমনি একটি ক্ষুদ্র পত্রিকার মাধ্যমে একটা সমাজের উন্নয়নের শরীক হওয়া যায়। কারণ কলমের শক্তির থেকে বড় শক্তি এই ব্রহ্মাণ্ডে নাই। শহরের কৃষ্টি বা সংস্কৃতির পাশাপাশি প্রাচুর্যতা ও বিলাসিতা বিদ্যামান। সে স্থানে যা পরিবর্তন হয় তা এতটা প্রভাব না ফেলতে পারলেও, গ্রামের উন্নয়নে লিটল ম্যাগাজিনের গুরুত্ব অনবদ্য। তাই, সকল লিটল ম্যাগাজিন বা ক্ষুদ্রপত্রপত্রিকার সার্বিক সাফল্য ই দীর্ঘ আয়ু কামনা করে গ্রামের মানুষ ও তাঁদের সরলতার মাঝে উন্নত চেতনার বিকশিত করার অন্যতম ভেলাস্বরূপ এই পত্রিকাগুলিকে আমার মস্তকে ধারণ করি।
রচনাকাল : ১৫/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।