শুভনীল, সমীরন, অপূর্ব, কৃষ্ণেন্দু আর অরুনাভ একসাথে পড়াশোনা করেছে। তিন বৎসর হোস্টেলে দিন কেটেছে। দক্ষিণ কলকাতার স্বনামধন্য আশুতোষ কলেজের ছাত্র। সকলের বিষয় একই না হলেও হোস্টেলে থাকার সুবাদে বন্ধুত্ব জোরালো। এক সাথে কলেজ, সিনেমা, পার্ক, আড্ডা আর রবিবারের সকালে জেলমাঠে গিয়ে ক্রিকেটের পাঠ নেওয়া। মাঝে মাঝে সকালে উঠে যোগমায়া দেবী কলেজের মেয়েদের যে ঝাড়ি মারে নি তা নয়। তবে ওই পাঁচ জনের মধ্যে শুভনীল বরাবর একটু রক্ষ্মনাত্মক। ওর পছন্দ পড়াশুনার ফাঁকে একটু ব্রিটিশ কাউন্সিল বা বান্ধব সমিতির লাইব্রেরীতে গিয়ে বই ঘাঁটা। আর অবসরে নন্দন চত্বরে গিয়ে ছবির প্রদর্শনী দেখা বা দু একটা আর্ট ফিল্ম দেখা কিংবা উত্তম মঞ্চের নাটক উদরস্থ করা। ভাবধারা ভিন্ন হলেও পাঁচ বন্ধুর মতান্তর ঘটেছে খুবই কম। আজ শুভনীল বসে আছে উত্তর কলকাতার বই পাড়ার বিখ্যাত কফি হাউসে। আজ থেকে বিশ বছর আগে এই দিনটিতে তার জন্মদিনের পার্টি শেষে বসন্ত কেবিন থেকে সোজা এই কফি হাউসে টানা আড্ডা। সেদিনের সেই কথা ভাবতে ভাবতে শুভনীল একটু আবেগপ্রবন হয়ে পড়ে। সেদিন তাঁদের আড্ডার বিষয় ছিল কে কেমন মেয়ে বিয়ে করবে। সেদিন সবাইয়ের মতো শুভ তার মতামত জানিয়েছিল। কিন্তু মাঝে বেশ কয়েকটা বছর চলে যায়। সবাই একে একে জীবনে প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে একে অপরের সাথে সংযোগ কমে যোগাযোগ বেড়েছে। মাঝে শুভনীল অনেক চিন্তা ভাবনা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে সে বিয়ে করবে না। বিয়ে করলে তার স্বাধীনতা, তার সুখ, তার আনন্দ, বিলাস সবকিছুতে একটা নিয়ন্ত্রিত হবে, হারিয়ে যাবে তার সৃষ্টি সুখ। তাই বিয়ে করা যাবে না। সারা জীবন একা থেকে সাহিত্যচর্চা করে যাবে। এই ভাবনা থেকে শুভনীল আর সাত পাকে বাঁধা পড়ে নি। আজ একচল্লিশটা বসন্ত পেরিয়ে জীবন নদীর কিনারায় পৌঁছে শুভ ভাবতে শুরু করেছে যে সে যেটা করেছে তা কি ঠিক, নাকি তার বন্ধুরা ঠিক করেছে? কে বেশী সুখী? আজ শুভনীলের অর্থ আছে, গাড়ি আছে, বাড়ি আছে, আছে যশ, খ্যাতি, প্রতিপত্তি। সব আছে। এর সাথে আছে সুখ, আছে স্বাধীনতা। আছে মদ, আছে সিগারেটের নেশা। যখন খুশি যেখানে যেতে পারে, সিনেমা, বইমেলা, কফি হাউস, নন্দন। কেউ বাঁধা দেবার নেই। সবাই আটকা পড়ে গেছে সংসারের জালে। আমিই সুখী, কেবল আমিই সুখী। এই ভাবে বিহ্বল হয়ে কফি হাউস থেকে বেরিয়ে আসছে। এমন সময় দেখা হয়ে গেল সমীরণের সাথে। সঙ্গে তার স্ত্রী সুমনা ও ছেলে আর মেয়ে। কিরে কেমন আছিস সমীরণ? ভালো আছিস? কোথায় গেছিলিস? ভালো আছি রে। ছেলেকে ফিজিক্স অনার্সে ভর্তি করতে প্রেসিডেন্সি কলেজে এসেছিলাম। আর মেয়ে কোন ক্লাস? মেয়ে তো সাউথ পয়েন্টে। ওর ক্লাস এইট। এই কোনরকমে চলে যাচ্ছে বউ বাচ্ছা নিয়ে। শুভনীল কে বিদায় জানিয়ে সমীরন এগিয়ে গেল ট্রেন ধরবে বলে। শুভনীল সিগারেট ফুঁকাতে ফুঁকাতে এসে কলেজ স্কয়ারের চাতালে বসে ভাবতে লাগলো। কে সুখী? তার কাছে সব আছে। কিন্তু কোথায় সেই শিশুর হাসি? কোথায় সেই সন্তানের সাফল্যের বিজয় উল্লাস? কোথায় সেই ফুটফুটে রমণীর পরামর্শ আর ভালবাসা। এসব পেয়ে কি সমীরণদের সুখ স্বাধীনতা সব উবে গেছে? তা নয়। সব আছে। তাহলে তার এই সম্পত্তি যার জন্য সে এত পরিশ্রম করেছে তার উত্তরসূরি বা কোথায়? তার অবর্তমানে এসকল সম্পদ তুচ্ছ। শুভনীলের আকাশে সূর্য অস্তমিত হলেও আজ সে বুঝেছে অপার্থিব প্রেমের থেকে বাৎসল্য প্রেম, মধুর প্রেমে আটকা পড়া ঢের ভালো। দায়িত্ব নিয়ে কর্তব্য পালনে অনেক বেশী স্বাধীনতার সুখ প্রদান করে। এই তো সেদিন রাত্রে ফ্লাটে ঘুম থেকে উঠে রাত্রে বাথরুম যেতে গিয়ে মাথাটা ঘুরে গেল। ব্যাস, চোখ খুলতেই দেখি হসপিটালের বেড-এ। ভাগ্যিস বাড়িওয়ালার বখাটে ছেলেটা খোঁজ নিয়েছিল। নইলে সেদিন তো ভবলীলা সাঙ্গ হবার কথা। এ সকল চিন্তা করতে করতে শুভনীল উঠে বাড়ির পথ ধরল। কি জানি, হয়তো এবার বিকেলে ভোরের ফুল ফোটাবে। পরম সুখের সন্ধান করবে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই গল্পের কাহিনী ও সংশ্লিষ্ট চরিত্র সবই কাল্পনিক। ঘটনার মধ্যে কেউ যদি তাঁর জীবনের বাস্তব ছবি প্রতীয়মান হতে দেখেন তাহলে অনুগ্রহপূর্বক এড়িয়ে যাবেন। ধন্যবাদ।
রচনাকাল : ১৫/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।