সৌরভ আর অমল দুজনে খুব ভাল বন্ধু। ছোটবেলা থেকে একে অপরের সাথে মাণিকজোড়ের ন্যায় ঘুরে বেড়াত। এ পাড়ার সব লোক একবাক্যে তা স্বীকার করে এখনও। তারপর ধীরে ধীরে প্রাথমিক স্কুল ছেড়ে বড় স্কুলের দরজায় পা রাখতে গিয়ে হোঁচট খেল অমল। সে বছর না পারলেও পরের বছর পঞ্চম শ্রেনিতে ভর্তির সুযোগ পেয়ে আবার দুই বন্ধু একসাথে স্কুলে যাওয়া আসা করে। শুধুমাত্র ক্লাসের টাইমটা বাদ দিলে বাকি সময়টা একসাথে কাটে দুই হরিহর আত্মার। বাদ সাধল মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষায়। এবারেও আটকা পড়লো অমল। ততদিনে সৌরভ মাধ্যমিক পাশ করে শহরের বড় স্কুলে সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হয়ে গেছে। এমনিতেই একটা বছর একা একা কেটেছে। তবুও বাড়ির চাপে পড়ে বাড়িতে বসে আরও একবার প্রবেশিকা পরীক্ষায় বাকি সম্মানটুকু বিসর্জন দিয়ে আর ঝুঁকি নিতে পারল না অমল। পরপর দুবছর প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ না করতে পেরে অমল পড়াশুনো ছেড়েই দিল। সৌরভ সেই বছরই জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়ে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র। অমলের সাথে সৌরভের যোগাযোগ ধীরে ধীরে কমতে কমতে বিচ্ছিন্ন হল কালের অমোঘ নিয়মে। মাঝে অনেকগুলো বসন্ত পেরিয়ে গেছে। অমলের পালে আর সৌরভের সুগন্ধ আসে না। তার নৌকায় অনেক নতুন নতুন বন্ধুরা ভিড় করেছে।অমল তার মতো করে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে অমল নতুন সংসার পেতেছে। ছেলেমেয়ের বাবা হয়েছে। একটা ইঞ্জিন ভ্যান কিনেছে। সারাদিন পরিশ্রম করে ভালো আয় করে। ছেলেমেয়েকে কে.জি. স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। বড় ছেলে অনন্ত ক্লাস ফাইভে উঠেছে। প্রথম দশে নাম। স্ত্রী সুমিত্রা ও সন্তানদের নিয়ে অমলের সংসারে সুখের অন্ত নাই। অমলের মত সুমিত্রারও বেশি কিছু চাহিদা নেই। তাই তাদের উপার্জনের কিছু থেকে প্রতিদিন নিয়ম করে সুমিত্রা মেয়ের বিয়ের জন্য সরিয়ে রাখে আর মাসের শেষে কাছের পোষ্ট আপিসে গিয়ে জমা করে দেয়। অমলের সাথে সুমিত্রা স্বপ্ন দেখে। তারা হাসে প্রান খুলে। একে অপরকে সময় দেয়, গুরুত্ব দেয়। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে। এভাবেই দিন যায়, দিন আসে। সপ্তাহ ব্যাপী গ্রামের বাৎসরিক মেলা শুরু হয়েছে। তাদের গ্রাম আর আগের মতো নেই। অনেক উন্নত হয়েছে। রাস্তাঘাট পটপরিবর্তন ঘটে গেছে। তো একদিন সুমিত্রা ও সন্তানদের নিয়ে পৌঁছে গেল অমলের ইঞ্জিন ভ্যানটা। ভ্যানটা এক সাইডে রেখে মেলার মধ্যে প্রবেশ করে সবাই। তাদের চোখে মুখে আনন্দের ছাপ প্রতীয়মান। খুশিতে ডগমগ ছেলেমেয়েরা। মেলা ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছাল কাঠের নাগরদোলার কাছে। ছেলেমেয়ের আব্দারে তারাও চড়ে বসল নাগরদোলায়। নাগরদোলা ঘুরছে, অম্ল-সুমিত্রার সুখের চক্র ঘুরছে। আনন্দে বিহ্বলতা কাটিয়ে নাগরদোলা থেকে নেমে সোজা মা কালী রোল সেন্টারে। সেখানে সবাই মিলে একটা টেবিল জুড়ে এগ চাউমিন খেয়ে বেরিয়ে ভ্যানের দিকে যাবে অমল। ঠিক সেই সময়, অমলের সামনে চেনা চেনা একটা মুখ ভেসে এল সামনের রাস্তার উপর রেস্টুরেন্ট থেকে।সৌরভ। সেই ছোটবেলার সৌরভ। সৌরভ অমলকে দেখে চিনতে পারে নি। অমল এগিয়ে গিয়ে দেখল একটি মেয়ের সাথে কথা কাটাকাটি চলছে। কি জানি হয়তো ওর স্ত্রী হবে। আরও দেখল অমল টেবিল জুড়ে দামী দামী খাবার অর্ডার দেওয়া হয়েছে। সেসবে হাত দেওয়ার আগে তাঁদের মধ্যে কোন একটি বিষয় নিয়ে তুমুল ঝগড়া বেঁধে গেছে। মেয়েটি রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেল। সৌরভও উপায়ান্তর না দেখে বিল মিটিয়ে বেরিয়ে গেল রেস্টুরেন্ট থেকে। খাবার গুলোর ভবিষ্যৎ দেখার জন্য অমল আর দাঁড়িয়ে না থেকে ছোট ছেলেটাকে কাঁধে তুলে ভ্যানের দিকে এগিয়ে গেল। ওখানে গিয়ে সবাই একটা করে দু টাকা করে বরফ (আপনারা পড়ুন আইসক্রিম) কিনে চুষতে লাগলো। কি পরম আনন্দে তারা এই সুখ চুষে খাচ্ছে তা একমাত্র অন্তর্যামী জানেন। সুমিত্রা বাচ্চাদের নিয়ে ভ্যানে বসে থাকতে থাকতে অমলকে পাঁচশো গরম গরম জিলিপি নিতে বলল। অমলও দৌড়ে গেল। জিলিপি নিয়ে ফিরে আসার পথে আবার সৌরভের সাথে দেখা। অমল তখন কথা না বলে থাকতে পারল না। কিরে ভালো আছিস সৌরভ? প্রথমটা না চিনতে পারলেও অমলের সেই চিরাচরিত ভঙ্গিমা মনে করিয়ে দিল। বলল ভালো তো ছিলাম। কিন্তু কাল হল বিয়ে করে। এ মহিলার জন্য যাই করি না কেন কোন কিছুতেই তুষ্ট করা যায় না। সব সময় একটা অশান্তি লেগে আছে। তা তুই কেমন আছিস? কোথায় থাকিস? আমি ভালো আছি রে বন্ধু। আর যেখানে থাকার কথা ছিল সেখানেই আছি। সৌরভের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। পশ্চিম গগনে সূর্য ঢলে পড়ছে। অমল বলল আসি বন্ধু, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। অমল তার স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে মহানন্দে মেলা থেকে ঘুরে বাড়িতে ফিরে এলো। রাত্রে অমল বলল সুমিত্রা আজ আর রান্না করার দরকার নেই। যা ভাত আছে ওতে জল ঢেলে জিলিপি দিয়ে খেয়ে নেবক্ষন। সেইমত তারা সেদিন রাতের খাওয়া সেরে সুখনিদ্রায় গেল। পরে একবার সৌরভের সাথে অমলের দেখা হয়েছিল। তখন অমল শুনেছিল সৌরভের ডিভোর্স হয়ে গেছে। প্রশ্ন সুখ কোথায়? ভালো বাসায় না ভালবাসায়? এক রমণীর প্রভাবে অমলের জীবনে নতুন স্বপ্ন রচনা আর এক জনের পাল্লায় পড়ে সৌরভের বিলাস বৈভবে পরিপূর্ণ জীবনে অমাবস্যার কালো চাঁদ। অর্থ তো এখানে নিমিত্তমাত্র। অনুভূতিটাই আসল। প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই গল্পের কাহিনী ও সংশ্লিষ্ট চরিত্র সবই কাল্পনিক। ঘটনার মধ্যে কেউ যদি তাঁর জীবনের বাস্তব ছবি প্রতীয়মান হতে দেখেন তাহলে অনুগ্রহপূর্বক এড়িয়ে যাবেন। ধন্যবাদ।
রচনাকাল : ১৫/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।