সুখের বিড়ম্বনা
আনুমানিক পঠন সময় : ৪ মিনিট

লেখক : সনৎকুমার পুরকাইত
দেশ : India , শহর : ডায়মন্ডহারবার

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , জুন
প্রকাশিত ৯৭ টি লেখনী ৪০ টি দেশ ব্যাপী ৩৭৮০৮ জন পড়েছেন।
Sanat Kumar Purkait
      ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬। ছুটির দিন। রোববার। ভেবেছিলাম একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠব। কিন্তু আজ ভোরবেলা হটাত করে ঘুম ভেঙ্গে গেল। বাইরের কিছু একটা গুঞ্জন কানে আসছে। জানালার পর্দাটা সরাতে দেখলাম ভোর না সকাল হতে চলেছে। সামনের তিনতলা মজুমদার ভিলার সামনে প্রচুর লোকসমাগম। কিছু সাদা পোশাকের কলকাতা পুলিশের সিপাইকে দেখা যাচ্ছে। সবাই একে অপরের সাথে নিজেদের মধ্যে কোন একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছে। আমিও কৌতূহল নিয়ে তরতর করে নেমে গেলাম। ব্যাপারটা কি জানতে। সিঁড়িতে বাড়ির দীর্ঘদিনের কাজের লোকটির সাথে দেখা হতেই কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই ওই বলতে শুরু করল। জানো দাবাবু, সামনের বাড়ির সেই মজুমদার বুড়িমা কবে মরেছে তা কে জানে।  পচে গন্ধ বেরোচ্ছে। তাই নিয়ে হুলুস্থুল চলছে নিচে। পুলিশ এয়েছে, তুমি আবার এসবের মাঝে জড়িয়ো না বাপু। যাইহোক, আসল কথায় আসা যাক, সামনের বাড়ি মানে ঐ মজুমদার ভিলার একমাত্র বাসিন্দা ছিলেন নবতিপর তিলোত্তমা মজুমদার। একসময় তিলোত্তমা দেবীর ভরা সংসার ছিল। অনীক মজুমদার মানে তিলোত্তমা দেবীর স্বামী মারা গেছেন আজ প্রায় বছর পনের হল। তবে মারা যাওয়ার আগে দুই ছেলে ও এক মেয়ে সবাইকে ভাল জায়গায় পৌঁছে দিয়ে গেছেন। প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী অনীক বাবুর প্রচুর সম্পত্তি থাকলেও ছেলেরা তাঁর ব্যবসায় কোনদিন আকৃষ্ট হয় নি। তাই মিঃ মজুমদার পড়াশুনার সাথে সাথে তাদেরকে বিদেশে চাকরী বা ব্যবসা কোনটাতেই না করেন নি। প্রত্যাশা ছিল যে একদিন কেউ না কেউ তাঁর ব্যবসার হাল ধরবে। না কেউ ধরে নি হাল। তাই তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথেই ব্যবসার মালিকানাও ধীরে ধীরে হস্তান্তর হতে শুরু করে। এখন মজুমদার বাড়ির একমাত্র কন্যা চন্দ্রানী তাঁর বিবাহিত জীবনে সুখে সংসার করছেন। দারুন বিত্তশালী স্বামী। বাড়ি, গাড়ি প্রতিপত্তি সবই আছে। ছেলেরা কেউ মজুমদার ভিলাতে থাকে না। তাই আজ গত পনের বছর ধরে বিশালাকার  মজুমদার ভিলার একমাত্র বাসিন্দা ছিলেন এই তিলোত্তমা দেবী। কেই বা থাকবে! দুই ছেলের একজন আমেরিকায় থাকে।  নামকরা ডাক্তার। সময় পেলে বছরে এক দুবার আসে। ডাঃ শুভঙ্কর মজুমদার। শুভঙ্কর তিলোত্তমা দেবীর বড় ছেলে। তখনও ডাক্তার হয়ে ওঠে নি। মাকে কথা দিয়েছিল, বিলেত থেকে এফ.আর.সি.এস. কমপ্লিট করেই কলকাতায় ফিরে সেবা করবে মানুষের। কিন্তু আর ফেরা হয় নি। ততদিনে বিদেশী আদব কায়দা বুঝে নিয়ে ডাক্তার বিদেশিনীর কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছে। গত পনের বছরে মাকে দেখতে কতবার দেশে এসেছে সে হাত গুনে বলে দিতে পারবে প্রতিবেশীরা। অন্যদিকে, ছোট ছেলে রমেন ব্যবসার কাজে সৌদিতে। তার আর আসার সময় কোথায়? রমেন মজুমদার ছোট বেলা থেকে খুব একটা ভালো রেজাল্ট না করতে পারলেও বাবার সম্পত্তি ধ্বংস করে সৌদি আরবে কি যেন একটা ব্যবসা ফেঁদেছে। চিরকাল অভিমানী রমেন বলে গেছে যে মজুমদার দম্পতি নাকি বড় ছেলে আর মেয়েকে মানুষ করতে গিয়ে তার দিকে ফিরে তাকানোর ফুরসৎ পায় নি। সেই অভিমানে সময় পেলেও রমেন খুব একটা দেশে আসে না। শোনা যায়, সেখানে বিয়েও করেছে। তিলোত্তমা দেবী গত পনের বছর নিঃসঙ্গ জীবনে আত্মীয়পরিজন ছাড়া প্রতিবেশীদের সাথে সময় কাটিয়েছেন। কিন্তু, গত মাস তিনেক তিলোত্তমা দেবীকে খুব একটা দেখা যেত না। বড় ছেলে শুভঙ্কর এসেছিল গত জুন মাসে। মাকে নাকি বলে গেছে তার ডিভোর্স হয়ে গেছে। খুব তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে আসবে। মায়ের চোখের দু কোন বেয়ে জল গড়িয়ে আসে। মা তিলোত্তমা খুব একটা আর চলাফেরা করতে পারছিল না। তাই মাস তিনেকের জন্য কিছু খাবার কিনে দিয়ে ডাঃ শুভঙ্কর মজুমদার বিদেশ পাড়ি দিয়েছে ঘরের দরজা জানালা বাইরে থেকে বন্ধ করে। তিলোত্তমা দেবী অবশ্য সে সব খাবার স্পর্শ করে দেখেন নি। অন্তত পুলিশের বক্তব্য তাই। পুলিশ যখন দরজা ভেঙ্গে ঘরের ভিতরে ঢোকে তখন তিলোত্তমা দেবীর দেহের রক্ত মাংস বিন্দুমাত্র ছিল না। শুধুই জীর্ণ কঙ্কালটাই খাটের উপর পড়েছিল। হয়তো যেদিন শুভঙ্কর চলে গেছে সেদিন লজ্জায়, ঘৃণায়, অপমানে আর তীব্র অভিমানে নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। তিলোত্তমা দেবীর কি ছিল না। সবকিছু ছিল। টাকা পয়সা গাড়ি বাড়ি ধনরত্ন সব ছিল। ছিল না শুধু সন্তানদের কাছ থেকে ভরসা। ছিল না তাঁর সন্তানদের দায়িত্ববোধ। তৈরি করতে পারেন নি সন্তানদের কর্তব্যপরায়ণ শিক্ষা। আজ এই বার্ধক্যে পৌঁছে সব থেকেও তাঁর কাছে কিছুই ছিল না। মেয়ে চন্দ্রানী সুখের সাগরে ভেসে মায়ের কথা খুব একটা মনে পড়ে না। মাঝে মাঝে টেলিফোনে যোগাযোগ রাখত। মা তিলোত্তমা বুঝেছিলেন যে এদের সাথে আমার যোগাযোগ বাড়ছে, সংযোগ কমছে। পুলিশ বিকৃত দেহ নিয়ে মজুমদার ভিলা সিল করে দিয়ে চলে গেল। সামনের জটলাটা ফাঁকা হয়ে গেল। প্রশ্ন রয়ে গেল, সুখ কোথায়? প্রতিষ্ঠিত তিন সন্তানের অভিভাবকহীন মরা পচা গলা দেহে নাকি দারিদ্রে ক্লিষ্ট সন্তানের কাছে বয়স্ক পিতামাতার শুধু দিনান্তে প্রানেমনে সংযোগ স্থাপন। যশ, খ্যাতি আর প্রতিষ্ঠায় যদি আমরা অন্ধ হয়ে যায়, তাহলে অন্তত বাবা মাকে নচিকেতার বৃদ্ধাশ্রম পর্যন্ত পৌঁছে দিই। তাতে যে কটা দিন বাঁচবে নিজেদের সুখ দুঃখের হিসাব নিকাশ একে অপরের সাথে শেয়ার করে শান্তিতে মরতে পারবে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই গল্পের কাহিনী ও সংশ্লিষ্ট চরিত্র সবই কাল্পনিক। ঘটনার মধ্যে কেউ যদি তাঁর জীবনের বাস্তব ছবি প্রতীয়মান হতে দেখেন তাহলে অনুগ্রহপূর্বক এড়িয়ে যাবেন। ধন্যবাদ।       
রচনাকাল : ১৫/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 2  China : 4  Europe : 2  Germany : 1  India : 68  Ireland : 4  Russian Federat : 9  Sweden : 1  Ukraine : 6  United States : 68  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 2  China : 4  Europe : 2  Germany : 1  
India : 68  Ireland : 4  Russian Federat : 9  Sweden : 1  
Ukraine : 6  United States : 68  
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সুখের বিড়ম্বনা by Sanat Kumar Purkait is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫০৭০০৭
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী