প্রিয় পাঠক, জীবন দর্শনের অষ্টম পাতায় আমার একটা ইন্টার্ভিউ প্রকাশ করা হল। প্রিয় অভিজিৎ এর প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে যে দর্শন উঠে এল তা সবার সমানে উত্থাপন করে দিলাম। আপনার অনুভূতি জানাতে ভুলবেন না।
অভিজিৎ - আপনাকে একটা প্রশ্ন উপস্থাপন করলাম, একটা মানুষকে ঠিক কত দিক দিয়ে বিচার করে ওই ভালোটা বলা যেতে পারে? বা ভালো কি শুধু ভালোর মধ্যে অন্তরঙ্গ? কিভাবে ভালো খারাপের বিচার শালিসি হয়? জানি অপ্রাসঙ্গিক তাও.........
উত্তর - ভালো বলতে কোন ভালোর কথা বলছ? আর একটু প্রশ্নটা ক্লিয়ার করো।
অভিজিৎ - আমরা মানে মানুষেরা কি বিচার করার প্রাপ্তি পাই, মানুষটি ভালো হিসাবে? বা একটা মানুষকে ভালো কখন বলতে পারি? সেতো আবার সবার কাছে ভালো নয় তো, তাহলে স্বয়ং কিভাবে বিচার করে ভালো বলি মানুষকে?
উত্তর - ভালো মন্দ মূল্যায়ন অনেকটাই স্বার্থের দ্বন্দ্বে আঘাতপ্রাপ্ত। যদি মূল্যায়ন নীতি আর ধর্মের নিরিখে হয় তাহলে ভালোকে ভালো আর মন্দকে মন্দ বলতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু যদি স্বার্থ জড়িয়ে থাকে সেই বিচারে, তাহলে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। সেখানে ভালো মন্দের সাথে জড়িয়ে যায় প্রবঞ্চনা আর নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করবার মূল্যায়ন প্রক্রিয়া। আবার দেখতে হবে কে মূল্যায়নের দায়িত্বে আছেন। তিনি যদি নিজেই সৎপথে না থাকেন তাহলে তাঁর কাছে ভালো বলতে তিনি সবসময় তিনি যেটাকে ভালো মনে করেন, ভালো বোঝেন সেটাই করেন। কিন্তু সৎমার্গের জীব নিজের বিপক্ষে গেলেও ধর্ম আর নীতিজ্ঞানকে বাঁচাতে প্রকৃত ভালো কে ভালো বলেন, মন্দকে মন্দ বলেন। সেখানেই তাঁর ভালো হয়ে ওঠা। হতে পারে সেই ভালো গুনের জন্য তাঁর দৈন্যদশা। সেক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে তাঁর এই পরিণতি শুধুমাত্র সঠিকভাবে সাদাকালো বিচার করবার কারণে নয়, বরং সময়ের কাছে সমাজের বিকিয়ে যাওয়ার পরিণতি।
অভিজিৎ - আমি যথাযথ উত্তর পেলাম।
উত্তর - তাছাড়া বিশ্বকবির কথায় “সত্যকার আদর্শ লোক সংসারে পাওয়া দুঃসাধ্য। ভালবাসার একটি মহান গুণ এই যে, সে প্রত্যেককে নিদেন এক জনের নিকটেও আদর্শ করিয়া তুলে।”
অভিজিৎ - আচ্ছা দাদা নিজেকে নিয়ে একাত্ম হতে পারছি না। মনোযোগ বারংবার বিঘ্নিত হচ্ছে। কাজের ওপর দায়িত্ব হারিয়ে পড়ছে। ক্রমে ক্রমে চিন্তার দৈর্ঘ্য বাড়ছে, যেটাকে নিয়ে থাকতে চাইছি সেটার ওপরে মনোমালিন্য ঘটছে। জানিনা বন্দি আছি বলে কিনা.....কিন্তু এমনভাবে থাকতে কোনোরকম ইচ্ছেও নেই। একটু সমাধান দেবেন.....।
উত্তর - মনোযোগ হারায় বর্তমান কে বাদ দিয়ে যারা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে বেশী ব্যস্ত তাঁদের ক্ষেত্রে। তেমন যদি তোমার ক্ষেত্রে হয় তাহলে তুমি খুঁজে বের করো তোমার এই তৎপরতা কিসের জন্য? এর পশ্চাতে কোন ঘটনা বা কোন ব্যক্তির চাওয়া পাওয়া জড়িয়ে আছে। মনে রাখতে হবে সময় আর পরিস্থিতির কাছে আমরা দাস, সেটা কাটিয়ে উঠতে গেলে ধৈর্য ধরে বর্তমানকে সাজাতে হবে। সেটা হলে ভবিষ্যৎ তৈরি ঠিক হয়ে যাবে। আর যদি কোন ব্যক্তির চাহিদাগত অভিমান কাটাতে তোমার এই পরিণতি হয়, তাহলে তুমি তাঁকে সাবধানে এড়িয়ে যাও। কারণ তাঁর এই চাওয়া পাওয়া কোনদিন শেষ নাও হতে পারে, কিন্তু এই চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে নিজেই নিজেকে শেষ করে ফেলবে মনের অজান্তে।
অভিজিৎ - সমাধান খুব সুন্দর। কিন্তু গন্ডি থেকে হারিয়ে যাচ্ছি কেন আমি? আমিকে বারংবার খুঁজতে হয় কেন আমাকে? কেন এত ছন্দপতন? এর হিসাব কিভাবে আসবে?
উত্তর - যারা নিজেরা বুঝতে পারেন যে তাঁর পদস্খলন হচ্ছে, তাঁরা এটাও বুঝতে পারেন সেখান থেকে মুক্তির উপায় কি কি? শুধু সংযমের অভাব আর ষড়রিপুর তাড়নায় তাঁকে সঠিক মার্গে প্রবেশ করতে বারবার বাধা প্রদান করে থাকে। প্রতিদিন দিনের শেষে গিয়ে তিনি ভাবেন যে এটা করা উচিত হয় নি, কাল থেকে আর করব না। পরেরদিন সকালে উঠে আবার সেই একই ভ্রম করে বসেন। এটাই হল স্থিতিশীলতার অভাব। এর থেকে মুক্তির উপায় তো ‘আমি’ কে জানতে পারা। জীব তাঁর আমিত্ব কে জানতে চাই না বা পারে না বলেই তো তাঁর এত অহমিকা। কারণ, এই আমিত্ব খুঁজতে বসলে তা একেবারে শুন্য হয়ে দাঁড়ায়। এ দুনিয়ায় তুমি ভিন্ন সব বর্তমান, তুমি এসেছিলে রিক্ত হস্তে, যাবার সময় যাবেও রিক্ত হয়ে। মাঝে থেকে যাবে শুধু তোমার কর্মধারা। সেখানেই বেঁচে থাকবে তোমার আমিত্ব।
অভিজিৎ - পূর্বে এমন হত না, এমন সময়ে আমি এইগুলো বেশি অনুভব করছি! কিন্তু কেন আমি???? এর থেকে দাদা মুক্তির কোনো উপায় নেই?
উত্তর - আছে অভিজিৎ, মুক্তির উপায় চিরকাল আছে। সমস্যা থাকলে সমাধান থাকবেই। তবে সমস্যা সংকটজনক হলে সেই মুক্তির উপায় সাধনার মত কঠিন হয়ে যায়। তাই সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়। ভালো বই পড়তে হবে, জানতে হবে। যত মানুষ, তত চিন্তাধারা। তাই যত পড়বে, তত মানুষকে জানবে। চিনতে পারবে ভিন্ন ভিন্ন মার্গ। মার্গ চেনা হলে গন্তব্যে পৌঁছাতে অসুবিধা হয় না। কারণ মার্গ ভিন্ন হলেও গন্তব্য সবার এক। তাই কর্ম করতে হবে। মনে রাখতে হবে নিজেকে অলসতা থেকে মুক্ত করাই হবে প্রধান সোপান কারণ কবিগুরু বলেন, “সুশিক্ষার লক্ষণ এই যে, তাহা মানুষকে অভিভূত করে না, তাহা মানুষকে মুক্তিদান করে”।
অভিজিৎ - কিন্তু এইসময়ে দাঁড়িয়ে মনোযোগী তে অভাব কেন এতো? এর সমাধান কিভাবে পেতে পারি দাদা?
উত্তর - যোগ, যোগসাধনা করতে হবে। স্বামীজি বলেন গীতা পাঠ করা অপেক্ষা ফুটবল খেলা শ্রেয়। এর অর্থ তিনি গীতা পাঠ থেকে বিরত থাকতে বলেন নি। বলেছেন মনকে বাঁধতে হলে শরীর ভালো রাখা দরকার। শরীরচর্চা করলে মন হয় নির্মল। তাঁর জন্য দরকার নিয়মানুবর্তিতা, জীবনে শৃঙ্খলা, সৎ ও সাত্ত্বিক জীবন যাপন করা। অভিজিৎ, ভালো মানুষের সঙ্গ করো, কুকথা আর অসৎ মার্গ ত্যাগ করো। মনে রেখো, “ঘুরিয়া ফিরিয়া যেমন করিয়াই চলি না কেন শেষকালে এই অলঙ্ঘ্য সত্যে আসিয়া ঠেকিতেই হয় যে, শিক্ষকের দ্বারাই শিক্ষাবিধান হয়, প্রণালীর দ্বারা হয় না”। তাই প্রতিষ্ঠানের থেকে ব্যক্তির ভূমিকা অনেক বড়, যদি তিনি সৎ মার্গের হন।
অভিজিৎ - বেশ।
উত্তর - আর একটা কথা শিক্ষা শুধু গ্রহণে কাজ শেষ হয় না, শিক্ষার সঠিক প্রয়োগ চাই। “আমাদের শিক্ষার মধ্যে এমন একটি সম্পদ থাকা চাই যা কেবল আমাদের তথ্য দেয় না, সত্য দেয়; যা কেবল ইন্ধন দেয় না, অগ্নি দেয়”।
অভিজিৎ - আমি জানতেই পারিনি এগুলো থেকে কিভাবে আমি বেরিয়ে গেছিলাম।
উত্তর - যারা নিচের দিকে নামেন তাঁরা ভাবেন যে তাঁর নিজ ক্ষমতায় তিনি নামছেন এবং চাইলে পরে যখন খুশি উঠে আসবেন। তিনি জানেন যে এর পশ্চাতে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি রয়েছে কিন্তু অসৎ সঙ্গ তাঁর সেই জ্ঞানকে মাটি করে তাঁকে হিতাহিত জ্ঞানশুন্য করে তোলে। সেখানেই পতন হতে শুরু হয়। নীচে নামানোর বন্ধু অনেক থাকে, প্রশংসা থাকে। তাই সেই বিড়ম্বনার মাঝে আসল মার্গ থেকে বিচ্যুতি ঘটে নিজের অজান্তেই। যখন সম্বিৎ ফেরে তখন নিজের ক্ষমতা কাজে লাগাতে চেয়ে যখন পারেন না, তখন খোঁজেন মুক্তির উপায়। তুমি কি এমন কোন অসৎসঙ্গ পেয়েছ? তাহলে তা বর্জন করাই শ্রেয়।
অভিজিৎ- আসলে মন তো দাদা সততার ওপর সেও অনেকখানি নির্ভর করে। যখন মনের বিপরীতে কাজ হয় বা কাজ হতে দেখি তখন হারাতে হয় নিজেকে। মিথ্যের প্রসস্থতা, পরিবেশের অক্ষুন্নতা, সমাজের শিরদাঁড়া নষ্ট হয়ে যেতে দেখা, পরিবারের মধ্যে হিংসা ও সর্বোচ্চ পাওয়ার লালসায় জর্জরিত হওয়া, বিভেদ, সমালোচনা, মানসিকতার অবক্ষয় ইত্যাদি এসব ঘটনা যখন চোখের সামনে আলাপ দেখাতে আসে তখন নিজেকে সবথেকে অপরাধী মনে হয়, মনে হয় হেরে যাচ্ছি বারংবার গোটা হিসাবের কাছে। চিন্তা, ক্ষমতা, বিচার, বুদ্ধি, সহনশীলতা সবকিছু যেন পর হয়ে যায় ততক্ষণে। মনে হয় এত হিসাব পাওয়ার আমিই বা কে ?
উত্তর- বেশ....
অভিজিৎঃ আর তখন মুচড়ে যায় সমস্ত মনোযোগ, সংকল্প! হারিয়ে যায় নিজের অজান্তেই, হারিয়ে যেতে হয় নিজের ইচ্ছেই.....। বেলাশেষে মনে হয় সবকিছু প্রয়োজন, বাকিটা অলস মাত্র। এখানে খুব হাসি হাসতে গেলে পাগলের প্রলাপ, নিশ্চুপ থাকলে বোবা, বিদ্রোহ করলে সাহস দেখাচ্ছে বলে আর কাঁদলে লোকদেখানো। এসব খুশি আর কত বইবে মান-হুষ? আসলে নির্লিপ্ততা, বন্ধন, সম্পর্ক, ভালোবাসা এসব মাঝেমধ্যে মনে হয় সাজানো কথা। হারালে বোধ হয় শোনা থাকতো না অরুচিকর সংযোজন। ক্ষমা করবেন দাদা।
উত্তরঃ অভিজিৎ, তোমার এই অনুভূতি ভালো। কিন্তু ভাই! একটা কথা তো ভুলে গেলে চলবে না, যে তুমি একা হাতে এই সমাজের নোংরা পরিষ্কার করতে আসো নি বা চাইলে পরেও করতে পারবে না। তবে তোমার এই মতাদর্শ আর অনুভূতিকে সঙ্গ করে গড়ে তুলতে হবে সেই সমাজ, যেখানে গরিষ্ঠ হবে সমমনস্ক মানুষের দল। সেই দিনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, যুদ্ধে জয়লাভ করতে হলে, ক্ষেত্রবিশেষে রণভূমি ত্যাগ করে পলায়ন করতেও হয়। কর্ণকে বধ করতে যাতে অর্জুনের সুবিধা হয় সেজন্য কৃষ্ণ কর্ণকে রণভূমি থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন আর তাতেই সংহার করতে সুবিধা হয়। তোমার যদি এই মলিনতা না ভালো লাগে, তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। জীবের স্বরূপ নিজে বুঝবে, তারপর অন্যকে বোঝাবে। এর পরিণতি কি আর তা থেকে মুক্তির উপায় কি সেগুলো প্রতীয়মান করতে হবে। তবেই দেখবে সমাজ উচ্ছন্নে গেলেও একদিন জীবের মতি ফিরবে। সেটা একজন দুজন করে হতে পারে। মনে রাখবে নীচে নামার মানুষ বেশী, কারণ নীচে নামতে কোন অতিরিক্ত শক্তি ব্যয় করতে হয় না। উপরে ওঠার মার্গ কঠিন দর্শন আর চিত্তশুদ্ধির নিয়মানুবর্তিতার পরিচায়ক। যাক ভালো থেকো, আজ উঠি। আবার পরে কথা হবে।
রচনাকাল : ১৫/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।