প্রিয় পাঠক, আজ জীবন দর্শনের পাতায় দূরত্ব নিয়ে আলোচনা করতে চলে এলাম। আপনাদের কেমন লাগলো জানাতে ভুলবেন না। আসুন জানা যাক দূরত্ব বলতে আমরা কি বুঝি। আলোচনার শুরু করি একটি কথোপকথন দিয়ে-
-“আমি তোমায় একান্ত কাছের করে পেতে চাই, খুব খুউউউউউ....ব কাছের করে পেতে চাই”।
- ঠিক কত কাছে?
- “যতটা কাছে এলে সকল দূরত্ব অতিক্রম করা যায়”।
এই কথোপকথন আমার অন্য একটি লেখা থেকে তুলে দিলাম, কিন্তু শেষের লাইনটি আমার কাছে এক জীবন দর্শন হয়ে প্রস্ফুটিত। আমার এক মাষ্টারমশাই বলতেন, জীবনে তুমি সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে যতটা পথ পরিক্রম করবে সেটাই হবে তোমার অভিজ্ঞতা। তাই জীব একই জিনিস বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে উপলব্ধি করে থাকেন। তখন এক ভেবে লিখে গেলেও আজ নিজের লেখা নিজে পাঠ করতে গিয়ে নতুন করে অনুভব করলাম। সকল দূরত্ব অতিক্রম করার তাৎপর্য কি? দূরত্ব বলতে এখানে কি বোঝানো হয়েছে?
আমার প্রিয় পাঠক, যারা আমার লেখা পড়েন তাঁদের সবাইকে জীবন দর্শনের পাতায় স্বাগতম। আজ জীবন খাতার সপ্তম পাতা খুলে নিলাম আলোচনার স্বার্থে। আজকের আমরা আলোচনা করব দূরত্ব নিয়ে। আমরা জানি কোনো বস্তু বা বিন্দু একটি অবস্থান থেকে আরেকটি অবস্থানে স্থানান্তরিত হলে, প্রথম অবস্থান থেকে দ্বিতীয় অবস্থান অবধি ভেক্টরকে সরণ বলে। সরণের পরিমাণ হলো দুটি অবস্থানের মধ্যবর্তী ন্যূনতম দূরত্ব, অর্থাৎ সরলরৈখিক দূরত্ব। এতো গেল পদার্থবিদ্যার কথা। কিন্তু যে জীব তাঁর প্রিয়জনের কাছে নেই, সেই দূরত্ব সম্পূর্ণ একটা মনস্তাত্ত্বিক দিক। সেই দূরত্ব পরিমাপের কোন স্কেল আছে কি? আমরা সরলরৈখিক দূরত্ব অর্থাৎ দৈশিক দূরত্বের পাশাপাশি সময় দূরত্ব, মানসিক দূরত্ব, চেতনার দূরত্ব, দর্শনের দূরত্ব ইত্যাদি শুনতে পাই।
জীবের এই দূরত্ব জ্ঞান বোঝাতে আমি দুটি উদাহরণ তুলে ধরব। আশা করি অনেকের কাছে তা যথাযথভাবে প্রতীয়মান হবে। আপনারা লক্ষ্য করবেন যখন আমরা একজায়গায় দাঁড়িয়ে বসে গল্প করি, তখন খুব বেশী হলে এক মিটারের মত দৈশিক দূরত্ব থাকে একে অপরের থেকে। অর্থাৎ একজন কথা বললে নির্বিঘ্নে অপরজন শুনতে পান। কিন্তু যদি সেই গল্প বা আলোচনার নিরিখে ঝগড়া, বিবাদ, অশান্তি তৈরি হয় দেখা যায় আমাদের সবার কথা ধীরে ধীরে উচ্চস্বরে হতে থাকে। এই বিবাদ বা মনোমালিন্য যত বাড়তে থাকে ততই স্বর বাড়তে থাকে। কিন্তু কেন? আমরা কেউ ভেবে দেখেছি? দেখি না। একটু ভেবে দেখলে বুঝতে পারবেন যে আমাদের মধ্যে দৈশিক দূরত্ব একই থাকলেও মানসিক দূরত্ব অনেক বেড়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। অর্থাৎ আমরা একই স্থানে দাঁড়িয়ে নিজেদের মনে মনে অনেক দূরে চলে গেছি। যার কারণে একে অপরের মনে হচ্ছে যে আরও জোরে বলা দরকার। কারণ, একে অপরের কথা অন্যের কথার মাত্রা ছাড়িয়ে প্রতিষ্ঠা করতে পারলে তা নিজের যশ, খ্যাতি, প্রতিষ্ঠার মর্যাদা প্রতিপন্ন হয়। এই হল দূরত্বের আপেক্ষিক চেতনা।
আবার একে অপরের সামনে দাঁড়িয়ে দুচোখ দিয়ে দর্শন করি, কিন্তু প্রেম যত গাঢ় হতে থাকে এবং চরম পর্যায়ে গিয়ে একে অপরকে আবেগে আলিঙ্গন করে থাকে অর্থাৎ দুজনের মধ্যে দূরত্ব সবথেকে কম হয়ে গেল, তখন একে একে নিজের চোখ দুটি বন্ধ করে নেন। এটা ভাবজগতের বিষয়, আপনি নিজে নিজেই অনুভব করুন আর ভাবুন ঠিক যখন একে অপরের মধ্যেকার দূরত্ব সবথেকে কমিয়ে ফেললেন অপরজনকে ভালো করে চেনার বা দেখার জন্য তখন কেন চোখদুটি বন্ধ হয়ে গেল। কারণ, এতক্ষন আপনাদের মধ্যেকার দৈশিক দূরত্বের সাথে একটা মানসিক দূরত্ব ছিল তা প্রেমের আলিঙ্গনে এখন আর নেই। তাই আপনাদের চোখ দিয়ে দেখতে হয় না। তখন অন্তর দিয়ে অনুভব করেন একে অপরকে, হৃদয় ও মনের মেলবন্ধন ঘটে দুটি প্রাণের মধ্যে। জাগ্রত হয় ভক্তি ও শ্রদ্ধা, গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয় প্রেম। সকল দূরত্ব ছিন্ন করে একে অপরের মাঝে বেঁচে থাকে। একজন বাঁচে অপরের চেতনায়, চলতে চায় একই মার্গে, পৃথক পৃথক দর্শন হয়ে যায় একাকার। এই কয়েকদিন আগে পর্যন্ত কেউ কাউকে না চিনলেও দেখা যায় বিবাহ বা বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হলে জীব একসুরে কথা বলতে চান, যদি সেই বন্ধনের মধ্যে সততা থাকে। যদি সেখানে প্রতারণার বীজ শুরুতেই স্থাপিত হয়ে থাকে সেখানে দর্শন কেন সেই সম্পর্কের মাঝে কোন প্রাণও থাকে না।
সাধারণত, যখন কোন জীব আমাদের বন্ধন থেকে মরে যান, তাঁকে সময়ের হাত ধরে আমরা ভুলে যেতে পারি বা কালের নিয়ম বলে মেনে নিই। কিন্তু, আমাদের সুন্দর এক বন্ধন থেকে যখন কেউ নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করবার জন্য আমাদের ছেড়ে চলে যান তাঁকে ভুলতে আমাদের কষ্ট হয়। কিন্তু দেরীতে হলেও আমরা ভুলে যায়। এক্ষেত্রে জীবের আবেগজনিত কারণে কষ্ট পাবে, তবে কর্মের মাঝে যতই তিনি নিজেকে ব্যস্ত রাখবেন, ততই তাড়াতাড়ি তিনি এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবেন। এই জগতে মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক বিনে কোন সম্পর্ক স্থিতিশীল নহে। বর্তমান নীতিভ্রষ্ট সমাজে জীব তাঁর জননীকে ভুলে গেলেও জন্মদাত্রী কোনদিন সে সম্পর্কের ছেদ ঘটাতে পারেন না। সে সম্পর্ক তো বাৎসল্য প্রেমের সম্পর্ক, সেখানে দূরত্ব থাকলেও কোনকালেই দূরত্ব ছিল না, আজও নেই।
প্রকৃতপক্ষে, যারা উদ্দেশ্য নিয়ে কাছে আসে তাঁদের ক্ষেত্রে কোন দূরত্ব কমে না, নৈকট্য আসলেও মানসিক দূরত্ব শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত থেকে যায়। উদ্দেশ্য পূরণ হলে সেদিন সমাপ্ত হয় একে অপরকে চেনা, শুরু হয় নতুন করে জানা। তৈরি হয় একে অপরের প্রতি ঘৃণা, বাসা বাঁধে অশ্রদ্ধা আর প্রকট হতে থাকে প্রকৃত দূরত্ব। একটা নির্দিষ্ট সময় পর এই উদ্দেশ্য পূরণ না হলেও এই একই ঘটনা ঘটে থাকে। সরে যেতে থাকে একে অপরের থেকে। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা বা প্রেম যতক্ষন দূরে থাকে ততক্ষণ তার প্রাবল্য লক্ষ্য করা যায়, নৈকট্য বাড়লে তা সাময়িক গভীরতা বৃদ্ধি ঘটালেও বিনিময়ে কেড়ে নেয় প্রকৃত ভালোবাসার স্বরূপ, ভেঙ্গে যায় শ্রদ্ধার বন্ধন। ঘটে যায় অপ্রীতিকর দূরত্ব বৃদ্ধি।
সময়ের সাথে সাথে আমরা দেখছি ভারতের মাটিতে বসে আমেরিকা, ইউরোপ বা আফ্রিকানদের সাথে বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে যায়, কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানলে দেখা যায় একেবারে পাশের বাড়ির প্রতিবেশীকে তিনি চেনেন না। হতে পারে সেখানে সংস্কৃতি বা মর্যাদার দূরত্ব বর্তমান। কিন্তু ঐ বন্ধুদের সাথে তাঁর যোগাযোগ থাকলেও আত্মিক সংযোগ কোনদিন তৈরি হয় না। এই হল দূরত্বের বিধান। দূরত্ব যেমন কমালে আত্মীয়তা জাগ্রত হয় তেমন এতটাই কাছে আসার দরকার নেই যে সকল দূরত্ব অতিক্রম হয়ে যায়, কারণ যেদিন সকল দূরত্ব অতিক্রম হয়ে যাবে, সেদিন থেকে একটু একটু করে নতুন দূরত্ব তৈরি হয়। আমরা এই শিক্ষা তো দুধজলে বিস্কুট ডোবানো থেকে পেতেই পারি। এমনভাবে ডোবা যাবে না, যাতে নিজের সত্ত্বা বিসর্জন দিয়ে দুধজলের মধ্যে ভেঙ্গে পড়তে হয়। নইলে এক বালিশে মাথা দিয়ে হাজার মাইল দূরের মানুষের সাথে চ্যাট করতে হবে অর্থাৎ যে দূরে থাকে সেই কাছের আর যে কাছে থাকে সেই সবথেকে দূরের হয়ে যায় মনের অজান্তে। তাইতো কবিগুরু বললেন, “পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দূরত্ব কোনটি জানো? নাহ, জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত, উত্তরটা সঠিক নয়। সবচেয়ে বড় দূরত্ব হলো যখন আমি তোমার সামনে থাকি, কিন্তু তুমি জানো না যে আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি”।
রচনাকাল : ১৫/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।