পূর্ব প্রকাশিতের পর.........
প্রিয় পাঠক, এবার আসি গতপর্বের প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশে।
প্রশ্নঃ একজন ঘুষ দেওয়া চাকরীধারী (প্রতিযোগিতার যোগ্যতা ছাড়া উত্তীর্ণ) তিনি কোন কর্মযোগের ফল? অর্থাৎ যোগ্যতা ছাড়া ভেট দিয়ে চাকরি মেলে কোন কর্মফলে?
উত্তরঃ আবারও বলি এই জগতে যা কিছু ঘটে তার পশ্চাতে কোন না কোন কারণ থাকে। আর কর্মফল সে তো কর্মের বিধি অনুসারে হয়ে থাকে। তবে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, কর্মফল বা ভাগ্য বলে স্থিতিশীল কিছু নেই। জীব প্রতিমুহূর্তে তা নির্মাণ করে জীবের বর্তমান কর্ম ও নির্ণয়ের মাধ্যমে। এই প্রশ্ন শুধু অভিজিৎ বা মৃত্তিকার নয়, শত সহস্র পিছিয়ে পড়া মেধাবী ছাত্রসমাজের প্রশ্ন। কালে কালে, দেশে দেশে এ প্রশ্ন চিরকাল ছিল, আছে ও থাকবে। তবে মূলপ্রশ্নের সাপেক্ষে বলি চাকরিপ্রাপ্তির এই ফল অনেকটা দাতা আর গ্রহীতার রসায়নে তৈরি। এখানে দেখা হয় যে কোন পদ্ধতিতে প্রার্থী নির্বাচন করা হচ্ছে? সাধারণ নিয়মে সংশ্লিষ্ট নিয়োগের বিজ্ঞাপনে যে সকল নিয়ম নির্ধারণ করা হয়, সেটাই যোগ্যতা বলে ধরা হয়। তার বাইরেও যদি নিয়োগ পান তাহলে গ্রহীতার থেকে দাতা বেশী অপরাধী। কারণ তিনি বিধান ভেঙ্গে অন্য নিয়োগবিধি তৈরি করে অপরাধ করলেন। তার এই কর্মফল পরে পেতে হবে।
কিন্তু, প্রশ্ন উঠবে অযোগ্য প্রার্থী যে চাকরি পেয়ে গেলেন কোন কর্মের ফেরে? সেখানে একটা কথা মাথায় রাখবেন, নিয়োগকর্তা যে পিছনের দরজা খুলতে পারেন সেই কাণ্ডজ্ঞান তাঁর ছিল এবং সেই তথ্যের উপর ভিত্তি করে তিনি টাকাও গুছিয়েছেন এবং ঠিক লোকের সন্ধান করে তার হাতে সেই ভেট গুঁজে দিয়েছেন। এখানে আপনি যদি তা না পারেন তাহলে আপনি এই চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থ। অন্যায়, অপরাধ, অনাচার বা দুরাচার সেগুলো পৃথক আলোচনা। সেইহেতু এখানে কিন্তু ঐ প্রার্থীর কোন অপরাধ হল না, কারণ তার দরকার চাকরি। তিনি যেভাবে পেতে হয় সেই চেষ্টা করবেন। এবারে নিয়োগকর্তা যদি একটা প্রচ্ছন্ন বিধানের সাথে অপর একটি বিধান প্রকট করেন, আপনাকে সেই দুই বিধান জানতে হবে। এটাই যিনি করতে পারেন এবং চাকরি অর্জন করেন তিনি জয়ী। তার সেই অনুসন্ধানের কারণে তিনি জয়ী। এবারে আপনার প্রশ্ন আসতে পারে আমি তো জানি যে ঘুস দিয়ে চাকরি হচ্ছে, কিন্তু আমার সামর্থ্য নেই, তাহলে কি আমি অপরাধী? আপনি অপরাধী নন, তবে নিয়োগকর্তার ইচ্ছেতে এই কর্ম সম্পাদন হয় যেহেতু সেই ইচ্ছেকে গুরুত্ব দিয়ে আপনাকে কর্ম করতে হবে। কারণ আপনার লক্ষ্য চাকরি পাওয়া।
এবার সেই নিয়োগকর্তা যে অপরাধ করছেন তার ফল তিনি পাবেন সাথে সাথেই অথবা পরে, সে এজীবনে হতে পারে আবার পরজন্ম বিশ্বাস করলে মরণের পারে হতে পারে। আপনি খেয়াল করে দেখবেন, এই অপরাধে কত আধিকারিক চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছেন, কতজন নিজ নিজ পদ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। অনেক সরকারের পতন ঘটেছে। এবার সেই পতনের আশঙ্কায় সরকার যদি লুট করার সামর্থ্য অর্জন করে থাকে সেটাই তার কর্ম এবং তার ফল হিসাবে পুনঃবহাল থাকা। এবার আপনি বলবেন যে আমি ঘুষ দিয়ে চাকরি নিলে সেটা অপরাধ হবে না? সেক্ষেত্রে বলব একদম অপরাধ না, কারণ ওটাই ছিল নিয়োগের বিকল্প বিধি। আপনি সেটাই গ্রহণ করেছেন মাত্র। তবে বিবেকের দংশনে আপনি যোগ্য প্রার্থীর সামনে যাবেন না লজ্জায়, কিন্তু সচরাচর যারা এই সুবিধা নিয়ে থাকেন তাঁরা নির্লজ্জ প্রকৃতির হয়ে যায় অসদুপায়ে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও যোগ্য পদে আসীন হবার পর।
মুশকিল হল, জীবের যশ, খ্যাতি, প্রতিষ্ঠার জন্য চাকরীর প্রয়োজন। কিন্তু রাষ্ট্র সেই ব্যবস্থা কতটা উন্মুক্ত করতে পারলো বা দুর্নীতি থেকে মুক্ত করে যোগ্য প্রার্থীর সামনে তুলে ধরতে পারলো সেটা একটা বড় বিষয়। যে রাষ্ট্র কর্মের সংস্থান করতে পারে না, উল্টে যোগ্যতার সাথে আপোষ করে নতুনভাবে রেজাল্ট বা প্যানেল তৈরি করে সেখানে কর্মফল বলে কিছুই থাকে না। সেখানে নীতি বিসর্জন দিয়ে দুর্নীতি আর স্বজনপোষণকে করেছে এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যম। আবার অনেক প্রতিযোগী হাতে ডিগ্রি নিয়ে চাকরি না পাওয়ার দুঃখে হতাশায় ভুগছেন। কিন্তু বাস্তবে সেই পদের যোগ্যতা তাঁদের আছে কিনা সেটা যাচাই করার ক্ষমতা বা ইচ্ছে কোনটাই থাকে না, কারণ অনেক আগেই রাষ্ট্র সেই মূল্যায়ন ব্যবস্থাকে করেছে কলুষিত। সেখানেই ঘটে বিপর্যয়। প্রকৃতপক্ষে, রাজার দোষে রাজ্য নষ্ট, প্রজা কষ্ট পায়/গিন্নীর দোষে বাড়ি নষ্ট, লক্ষ্মী ছেড়ে যায়। যদি কোন মূর্খ লোক প্রশাসনে আসে সেখানে জ্ঞানীরা করে পলায়ন। অনাচার, অত্যাচার আর দুর্নীতিতে সবকিছু হয় অতিষ্ঠ। রাষ্ট্র হল নাগরিকের অধিকার রক্ষার ধারক ও বাহক। সেখানে সেই যদি কুকর্মে মত্ত হয়ে যায়, সেখানে প্রার্থীর কর্মের ফলাফল বিচার হয় না। হয় অনাচার, সেখানেই হয়ে যায় চরম অন্যায়। মহাভারতে পাণ্ডবদের বিনাকারণে জতুগৃহে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা থাকলেও সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ করে পাণ্ডবরা বাঁচলেও অন্যায়ভাবে নিষাদপত্নী ও তাঁর পাঁচসন্তানকে পুড়ে মরতে হয়েছিল। এখানে যে তত্ত্ব লুকিয়ে আছে আপনার প্রশ্নের উত্তরে সেই একই তত্ত্ব প্রচ্ছন্ন আছে। সেখানেও মূল উদ্দেশ্য ছিল আগুন থেকে মুক্তি পাওয়া, দুর্নীতি করে তাঁরা মুক্তি পেয়েছিল এবং তার ফলস্বরূপ পাঞ্চজন্য অনুসারে ব্যাধের তথা সেই নিষাদের হাতে কৃষ্ণের মৃত্যু। আর অন্যায় করে আগুনে পুড়িয়ে মারার উদ্দেশ্য ছিল বলে সেই কর্মের ফল হিসাবে কুরুবংশ ধংস।
রচনাকাল : ১৫/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।