জীবন দর্শন (তৃতীয় পর্ব)
আনুমানিক পঠন সময় : ৪ মিনিট

লেখক : সনৎকুমার পুরকাইত
দেশ : India , শহর : ডায়মন্ডহারবার

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , জুন
প্রকাশিত ৯৭ টি লেখনী ৪০ টি দেশ ব্যাপী ৩৭৮১৯ জন পড়েছেন।
 গত রাত্রে একটা গান শুনলাম, সেই গানের কথাগুলো এখানে ছবির সাথে তুলে দিলাম। সম্ভবত গানের গীতিকার ও শিল্পী ধ্রুব মহাশয়। সঙ্গীতের মধ্যে লেখা থাকে জীবনের কথা কারণ সঙ্গীত হল সমাজ জীবনের দর্পণ আর সেটা যদি হয় লোকসঙ্গীত। এই সঙ্গীতের কথায় জীবনের একটা দর্শন ফুটে উঠল। যে পাখি উড়ে যেতে চায়, তাকে আটকে রাখতে নেই। উড়ন্ত বিহঙ্গ হয়ে যে এসেছে ধরায়, তার জন্য এই বিশ্বচরাচর উন্মুক্ত করে দেওয়া ভালো। একটা সময় তার পক্ষদ্বয় ক্লান্ত হবে, সেদিন সে আর তার উৎসমূলে ফেরার ক্ষমতা রাখে না। এখানে আমরা দেখতে পাই যে পাখি তার মত বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াবে তবু সে প্রেমের বন্ধন স্বীকার করবে না। দশ দুয়ারে ঘুরে ঘুরে যে শত শত মন দখল করে তাকে কি দরকার এই মনের খাঁচায় আবদ্ধ করার। তাকে ছেড়ে দাও বিশ্বসংসারের জন্য। হয়তো তার অনেক বড় কাজের দায়িত্ব রয়েছে।

  এই বিশ্বসংসারে এমন কিছু মানুষ আসেন যারা কোন ব্যক্তির জন্য আসেন না, আসেন জগতসংসার কে উদ্ধার করতে। এমন অনেক মহাপুরুষ আছেন যারা নিজ স্বার্থ পরিত্যাগ করে জগতের কল্যাণে নিজেকে করেছেন উন্মুক্ত। তাঁদের নিজেদের কথা নিজেরাও ভাবার সময় পান নি। আমরা দেখেছি শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু জগতে প্রেমসুধা বিতরণ করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাতাবরণ তৈরি করেছিলেন অস্থির সমাজ ব্যবস্থাকে রুখতে। তিনি ঘরে কামিনীকাঞ্চন ত্যাগ করে চলে গেছিলেন। একাকিনী বিষ্ণুপ্রিয়া বা মাতা শচীরানী তাকে সোনার খাঁচায় আটকে রাখেন নি। তাঁর প্রেম জগতের জন্য, কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে সীমাবদ্ধ থাকার জন্য নয়। আবার ভগবান বুদ্ধ সকল প্রকার রাজসিক সুখ পরিত্যাগ করে সমাজের কল্যাণে নতুন মার্গ সন্ধান করতে বেরিয়ে পড়েছিলেন এক নতুন জীবনে। সেখানেও গোপা বা গোতমী কেউ বাধা দেন নি। তাঁরা এসেছিলেন অনেক গুরু দায়িত্ব পালন করতে। তাঁদেরকে আটকে রাখা যায় না।

  কিন্তু, পক্ষান্তরে কিছু কিছু মানুষ আবার অহমিকার জালে আবদ্ধ হয়ে এই সংসার থেকে চ্যুত করেন নিজেকেই। উদ্দেশ্য আরও আরও সুখ, আরও আরও প্রাপ্তি। লোভ, লালসা, মোহ, বাসনা আর কামনার আগুনে পুড়তে পুড়তে কখন যে বিপথগামী হয়ে নিজের ক্ষতি নিজে ডেকে আনেন তা তাঁরা নিজেরাই জানেন না, বলা ভালো সেই কাণ্ডজ্ঞান তাঁদের থাকে না। তাঁদের কাছে মনে সময় অফুরন্ত, সময়ের সাথে একটু খেলা করা যেতে পারেই। কিন্তু আমরা সবাই যে সময়ের দাস সেটা মাথা থেকে বেরিয়ে যায়। যৌবন মদমত্তা উন্মত্ত হস্তির ন্যায় ঘুরে বেড়াতে চায় এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। তারপর একদিন সময়ের কাছে হার মানে সকল বাহ্যিক দশা। সেদিন খুঁজতে বসেন অন্তরের অন্তঃস্থলে নিহিত শক্তির দিকে। কিন্তু সময়ের কাজ সময়ে না করলে সব হারিয়ে নিঃস্ব হতে হয়।

  প্রসঙ্গক্রমে, একদিন এক পাখি বন্দরের পাশ দিয়ে উড়ে যেতে যেতে দেখল এক বিরাট জাহাজ নোঙর করা আছে ঘাটে। তার বাসনা হল সে জাহাজের মাস্তুলে বসে সব কিছু উপর থেকে দেখবে আর তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবে জীবন। বেশ, সাথীদের ত্যাগ করে বিপথগামী হয়ে চলে গেল জাহাজের মাস্তুলে। এভাবেই বসে থাকতে থাকতে একটা সময় জাহাজ জেটি ত্যাগ করে দূরদেশে পাড়ি দিতে এগোতে থাকল। তবুও সেই পাখি মাস্তুল ত্যাগ না করে চারপাশের দৃশ্য দেখতে লাগলো। একটু একটু করে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পাখি ভাবছে এত ব্যস্ততার কি আছে ঐ তো তীর দেখা যাচ্ছে, একটু পরে উড়ে গিয়ে সাথীদের সাথে ভিড়ে যাবে। আরও এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে। পাখি এখন আর তীর দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু অহমিকা আর লালসার জোরে এখন আর তীরের কথা না ভেবে, ভাবছে এই তো উত্তর দিকে তীর ছিল তো। যাচ্ছি একটু পর। এ তো বেশী দূর নহে, এর থেকে অনেক বেশী দূরে উড়েছি। নিজের সামর্থ্যের উপর পূর্ণ বিশ্বাস। কিন্তু, ক্ষনিক পরে পাখির সম্বিৎ ফিরতেই উড়তে শুরু করল উত্তর দিকে। অনেকটা উড়ে যাওয়ার পরে তীর দেখতে পেল না, আবার এদিকে জাহাজও এগিয়ে চলেছে। জাহাজকে হারাতেও চাইছে না এই মাঝ সমুদ্রে। একটু একটু করে উড়ে যায় আবার ফিরে এসে বসে সেই মাস্তুলে। এভাবে উত্তর ছেড়ে পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিন দিকে গিয়ে তীরের সন্ধান না পেয়ে ক্লান্ত হয়ে মাস্তুলে এসে বসে ভাবতে থাকে এবার কি করণীয়। মহাজন বলছেন কিছুই করার নেই, যেদিন সামর্থ্য ছিল, সেদিন সময় থাকতে সঠিক সিদ্ধান্ত না নিয়ে অহমিকার পাখায় ভর করে শুন্যে উড়ছিলে। আজ তুমি ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, পরিশ্রান্ত। তুমি না পারবে উৎসে ফিরতে, না পারবে তোমার স্বপ্নের মাস্তুলে বসে জীবন কাটাতে। একটাই মার্গ, সে হল মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখতে দেখতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার সাথে সাথে প্রকৃত জীবন দর্শন। মৃত্যুই তোমার পথ।

  ঠিক তেমন এই জগত জীবের কাছে সঠিক সময়ে সঠিক মার্গে নিজেকে প্রতিস্থাপিত না করতে পারলে ঐ পাখির মত সুখের ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে একদিন প্রকৃত সুখ থেকে বঞ্চিত হয়ে হারিয়ে যেতে হবে এই বিশ্ব সংসার থেকে। তাই তো গীতিকার বললেন, পাখিটার এমন স্বভাব/ নিজের অভাব পূরণ করে নিজের মত/ পাখিটা হাসে খেলে অন্তরালে/সুনিপুন করে কত। ফলে নিজের সুখ পেতে গিয়ে সবাইকে করে অসম্মানিত আর সেই ক্ষনিকের সুখ থেকে হারিয়ে যায় চিরকালের মত। জীবশিক্ষার প্রধান অঙ্গ নীতিশিক্ষা। সেটার মধ্যে বিরাজ করে ত্যাগ, তিতিক্ষা, বিনয় আর প্রেমের উজ্জ্বল শিখা। তা যদি একবার আত্মস্থ করা যায় পাওয়া যায় পরমসুখ, আসে পরাবৈদিক শান্তি। খুঁজে পায় জীবনের মানে, এভাবেই জীবনকে করে সমৃদ্ধ। মৃত্যুর মাঝেও অমরত্ব লাভ করে দৃষ্টান্ত হয়ে যায়। আপনার জীবন আপনি কেমনভাবে কাটাবেন, সেটা আপনার জীবন দর্শনের উপর নির্ভর করবে।

গানের কথাঃ ধ্রুব


রচনাকাল : ১৫/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 5  China : 10  France : 1  Germany : 1  India : 92  Ireland : 2  Russian Federat : 10  Sweden : 11  Ukraine : 4  United States : 82  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 5  China : 10  France : 1  Germany : 1  
India : 92  Ireland : 2  Russian Federat : 10  Sweden : 11  
Ukraine : 4  United States : 82  
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
জীবন দর্শন (তৃতীয় পর্ব) by Sanat Kumar Purkait is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫০৭২৫০
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী