-“এ ভাই সুমো, একটা বিড়ি হবে? দেখ না, এটাই শেষবার। আর চাইব না কোনদিন”।
বক্তার বয়স পঁচাশি আর শ্রোতার বয়স খুব বেশী হলে তেরো। আজ থেকে প্রায় ছাব্বিশ বছর আগে। সৌম্যদীপ তখন মাধ্যমিক স্কুলের নিতান্ত এক ছাত্র। সৌম্য আমার খুব কাছের বন্ধু। তার কাছে করুণ সুরে চাইতেন তার পাশের বাড়ির এক অশীতিপর বৃদ্ধ। তিনি আজ অনেক বছর হল পরলোকে। যাইহোক, তিনি জানতেন ভালো করে যে সৌম্য এমনিতেই ছোট, তার কাছে থাকার কথা নয়। অবশ্য তাদের বাড়িতে তার ঠাকুরদা বিড়ি খেতেন। সেখান থেকে লুকিয়ে একটা ম্যানেজ করার জন্য বলতেন। এভাবে বারবার বলতে বলতে সৌম্যও বুঝে গিয়েছিল যে তিনি যতই বলুন যে এটা শেষবার, আর চাইব না কোনদিন, তা আর হবার নয়।
তো সেই সময়ে এত টিভি, মোবাইল, কেবল, ইন্টারনেটের দৌরাত্ম্য ছিল না আর সিনেমা দেখার খুব একটা সুযোগ ছিল না। থাকলেও সপ্তাহে রবিবার একটা ছায়াছবি। তা সেসময় মাদক বা ধূমপান নিয়ে এত বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণও ছিল না যেমন, তেমন এখনকার মত কোন সিনেমার শুরুতে বা বিরতির মাঝে এই সতর্কতামূলক বিজ্ঞাপন দেখাত না। তাই আমরাও এই মাদক বা তামাক কতটা ক্ষতিকর সেটা তখন এত বুঝতাম না। শুধু আমাদের এটাই বোঝানো হয়েছিল যে এসব শিশুদের ছোঁয়া নিষেধ। তাই নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের যেমন এক অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ কাজ করে, তা ছোট্ট সৌম্যেরও করত। তাই সে একদিন দোকান থেকে বিড়ি আনার অর্ডার পেয়ে বিড়ি কিনে ফেরার পথে একটা বিড়ি আগুন ছাড়া মুখে দিয়ে টেনে দেখেছিল, তবে মাঝখানে ফিল্টার হিসাবে ছিল একটা পাতলা গামছা।
ছেলেবেলার সেই দুরন্তপনা কাটিয়ে সৌম্য আজ পরিণত। আজ সেই সেদিনের দুরন্তপনা ছেড়ে সৌম্য এখন মাদক বা তামাকের ক্ষতিকর দিক নিয়ে বিভিন্ন আলোচনাসভায় বক্তৃতা দিয়ে বেড়ায়। আজ আন্তর্জাতিক মাদক বিরোধী দিবসে সেই মানুষটার কথা ভেবে সৌম্যের কষ্ট হয় না বা তার হাতে বিড়ি নিজে তুলে দিয়ে গেছে দীর্ঘদিন ধরে তার জন্য তার একটুও আফসোস হয় না। কারণ, নব্বই দশকে গ্রামীণ ভারতের দারিদ্র্য সবকিছু নিয়মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বাঁচার সাহস দেখিয়েছে। তখন সেই বৃদ্ধের ঠিকমত দু’বেলা খাবার জুটত না। তাই অনেক সময় এমন হয়েছে যে তিনি একটা বিড়ি খেলে তাঁর খিদে সংবরণ হয়ে যেত। এভাবেই খাদ্য নিরাপত্তার অভাবে নিজেকে তিলতিল করে তামাক বা মাদকের নেশায় নিজের ফুসফুস পুড়িয়ে একদিন এই পৃথিবী থেকে নীরবে বিদায় নিয়েছিলেন। কে বলতে পারে সেদিন তাঁর মৃত্যু খিদের জ্বালায় হয়েছিল নাকি মাদকের নেশায় হয়েছিল? সৌম্য তাঁর জন্য বিড়ি চুরি করত। কারণ তাঁর কিশোর মনে সেই বৃদ্ধের আকুতি আঘাত হেনেছিল। একটা মানুষের সেই আকুতি যে ভুল ছিল তা অনেক পরে বুঝেছে সৌম্য। কিন্তু সেদিন যদি বুঝতে পারতো তাহলেই বা কি করতে পারতো? সেই আসক্তি থেকে তাঁকে বের করে আনতে গেলে তাঁর নিত্যদিনের ন্যূনতম খাদ্যের পশরা তুলে ধরতে হত। সেসময় সেটা ছিল বিলাসিতামাত্র।
আজকের পৃথিবীর অনেক প্রাচুর্যের মাঝেও মানুষের দুঃখ, বেদনা, বিষাদ, অভিমান আর বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে নাকি সেই মাদক বা তামাকের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। কিছু মানুষ চিরকাল অভাবের জ্বালায় নিজেকে দগ্ধ করেছেন আর কিছু মানুষ সামাজিক মর্যাদা ধরে রাখার জন্য মাদকের নেশায় আজও বুঁদ হয়ে থাকতে ভালোবাসেন। আগামী পৃথিবী যখন বিজ্ঞান ও চিকিৎসার জগতে বিপ্লব আনতে চলেছে তখন তাঁদের হাতে মাদক বা তামাকের নেশা থেকে মুক্ত করবার চাবি শুধুমাত্র বিকল্প নেশা বা কাউন্সেলিং ছাড়া আর কিছুই নেই। আজকের দুনিয়ায় এত প্রচার, বিজ্ঞাপন, সতর্কীকরণ, শ্লোগান, ট্যাগলাইন বা ভয়ঙ্কর ছবি দিয়েও মানুষকে মাদকের আসক্তি কাটানো যাচ্ছে না, এমনকি সিনেমার মাঝে যখন এগুলি দেখানো হচ্ছে তখন পর্দার নিচে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ দেওয়া হচ্ছে। তাও মানুষ কে এই ঘৃণ্য মার্গ থেকে জীবনের মূলস্রোতে ফেরানো যাচ্ছে না। এর জন্য আমাদের আরও বেশী বেশী করে সচেতনতার বার্তা সমাজের বুকে দিয়ে যেতে হবে। আগামী পৃথিবী মাদকমুক্ত পৃথিবী হয়ে উঠুক এই প্রত্যাশা রাখি।
রচনাকাল : ১৪/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।