অনেক রঙ উপড়ে গেল নীল আকাশের নীচে,
দূরে কোথায় কাকের দল উড়ে যায়, নিঃসীম সীমানায়।
আমি বসে থাকি একা জানালায়।
আপন খেয়ালে ডেকে চলেছে ঝিঁঝিঁপোকা।
ব্যাঙটা মনে হয় লাফিয়ে জলে পড়ল।
মাছরাঙা একদৃষ্টিতে জলের দিকে তাকিয়ে।
আচ্ছা, মাছ কি ভুল করে মাথা উঁচু করে?
এতে কি তার অহমিকা প্রকাশ পায়?
শুনেছি অহংকার পতনের কারণ।
তাহলে বকের ঠোকাতে তার পতন নয়!!
-----------------*----------------
যা......................!!!!
ঝপাং করে নিভে গেল বিজলী বাতির আলো
বামুন পাড়ার কুকুরটা সমানে চিৎকার করে চলেছে।
শশীবাবুর বড় ছেলে কোথা থেকে কাকস্নান হয়ে বাড়ি ফিরল।
পাঁচ বছরের প্রহেলিকা ক’দিনের জ্বরে বেহুঁশ।
মা ব্যর্থ হয়ে ঠাকুর ঘরে বার বার মাথা কুটছে,সন্তানের আরোগ্য কামনায়।
ঠাকুর ঘরের দালানে পায়রা জোড়া অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে,
কি যেন একটা বলতে যাচ্ছিল-
ঠিক তখনি আকাশ ভেঙ্গে গর্জন আর বৃষ্টি নেমে এল।
পশ্চিমের জানালা দিয়ে জল ঢুকে ভিজে যাচ্ছে কিশলয়ের ছেঁড়া পাতা।
ভাতের হাঁড়ি উপছে পড়ল ফ্যান, নিভেও নিভছে না জ্বলন্ত চুল্লিটা;
বখাটে রামরতন মদমাতাল হয়ে বউ এর কাছে বসে
সারাদিনের রোজনামচা আওড়াচ্ছে সুর করে করে।
-----------------*----------------
বৃষ্টিটা একটু থেমেছে।
সদ্য গ্র্যাজুয়েট অমল দুটো টিউশন পড়িয়ে বাড়ি ফিরল
বৃষ্টিস্নাত অমল গামছা নিয়ে মাথা ঘষছে।
মা উৎসুক দৃষ্টিতে বললেন-
কে, ছোট খোকা নাকি? ইস্, ভিজে একসা হয়ে গেছিস তো!!
তা, ও অমল শোন না বাবা,
২০০ টাকা দিবি? মেয়েটার জ্বরটা আবার বেড়েছে।
অমল ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল, স্বপ্ন ভাঙ্গার বেদনায়।
মা...........................!!!!
দুটো মুড়ি দেবে, খুব খিদে পেয়েছে।
-----------------*----------------
গত ন’মাস ধরে টাকা জমানোর চেষ্টা করছে অমল।
অনেক দিনের সাধ একটা স্মার্টফোন কিনবে,
পুরানো প্রেমে আর একটু রসদ জোগাবে।
কিন্তু এই সংসার, তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে।
দুমুঠো মুড়ি খেয়ে মায়ের হাতে এ মাসের বেতন তুলে দিয়ে
সোজা বিছানায় ডুবিয়ে দিল নিজেকে, হতাশায় আর ঘেন্নায়।
সেই পুরনো নোকিয়া-১১১০ টা বের করে,
ডায়াল করে দিল ০৩১৭৪ ২৮৯***।
ফোনের অপর প্রান্তে চয়নিকা’র গলা পেয়ে অমল বলল,
“শোন না, আমি এই মাত্র পৌঁছালাম।
এদিকে লোডশেডিং, ফোনে চার্জ নেই একটুও।
আজ আর কথা বলা হবে না মনে হয়!!”
রমণী কণ্ঠ অভিমানে বিরক্ত প্রকাশ করে বলল,
“কোথায় যে থাকো? কই আর তো কারুর বয়ফ্রেন্ড এমন বলে না!
আসলে তা নয়, আমার জন্য তোমার সময় নেই।
বুঝি বুঝি...................!!!”
-----------------*----------------
প্রহেলিকার জ্বর আরও বেড়েছে, গত দুদিন ধরে কিছু খাচ্ছে না।
মা ডুকরে কেঁদে উঠল।
‘একটু রাখছি’ বলে অমল দৌড়ালো।
বৃষ্টিটা অঝোর ধারায় ঝরছে,
অমল বয়সের তুলনায় বুড়িয়ে যেতে বসেছে সংসারের চাপে
সকল সুখ আর শান্তি বিসর্জন দিয়ে দু’দিন পর.....
অমল তার স্বপ্ন সাথীকে ফোন করল।
সে দৃঢ়কণ্ঠে জানিয়ে দিল, তার আর কিছুই করার নেই।
“বাবার বন্ধুর ছেলে এসেছিল, বাবা মা ওকেই পছন্দ করেছে।
আমিও হ্যাঁ বলে দিয়েছি, আমি আর তোমাকে চাই না।
তাছাড়া, তোমার কোন মুরোদ নাই আমাকে বিয়ে করার।
আমাকে আর একদম ফোন করবে না”।
অমলের প্রেমের চুল্লীটা আজ দপ্ করে যেন নিভে গেল হঠাৎ।
কত শত অমল রোজ রোজ এমনি করে বলি দিচ্ছে,
বলি দিচ্ছে নিজেকে আর বুকের ভিতর জমে থাকা পিট্যুইটারির খেলাকে।
তবুও অমলরা বাঁচে, সংসারের সবার মাঝে বেঁচে থাকে।
বেঁচে থাকে তারা একরাশ কর্তব্য আর দায়িত্ব পূরণের মাঝে।
-----------------*----------------
১১ দিনের জ্বরে সংসারের সবথেকে আদরের প্রহেলিকা,
সবাইকে ছেড়ে চিরতরে বিদায় নিল।
অমল আরও পরিণত হল, সংসারের রূঢ় বাস্তব মেনে নিয়ে।
বুকে জগদ্দল পাষাণ তুলে আশ্রয় নিল, নিজের ঘরের জানালার পাশে।
আর ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ নেই, বৃষ্টি থেমে গেছে।
দুশ্চিন্তার মেঘ সরে গিয়ে, আকাশ অনেকটা পরিষ্কার আজ।
কুকুরের করুণ ডাক আর শোনা যায় না।
অমল এর ফোনে এখন চার্জ আছে, কিন্তু ব্যালান্স নেই।
সারাদিনে কয়েকটা জরুরী ফোন আসে,
যায় না তো আর........................!!!!
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস/ ২১ শে ফেব্রুয়ারী, ২০১৩
রচনাকাল : ১৪/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।