কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,
বহু দিন ধরে, বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যায় করি, বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা, দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশির বিন্দু
আজ সেই কথা মর্মে মর্মে অনুভব করলাম ঘরের কাছে শীতের ছুটি কাটাতে পিয়ালী দ্বীপে এসে। এতদিন রাজ্যের বাইরে ভিন রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে পাহাড় পর্বত কিংবা সবুজের সমারোহে বা সমুদ্রের নীলাভ ছোঁয়া নিতে ঘুরে এসেছি বহু জায়গায়। কিন্তু আমাদের রাজ্য না বলা ভাল আমাদের জেলার প্রত্যন্ত প্রান্ত জুড়ে ছড়িয়ে আছে বিচিত্র রকমের প্রাকৃতিক সম্ভার। তার টানে বন্ধুর ডাকে বেরিয়ে পড়লাম শীতের সকালে। সুন্দরবনের মিনিয়েচার রূপ এই পিয়ালী দ্বীপ। দু-একদিনের ছুটি কাটানোর দারুণ জায়গা পিয়ালি নদীবেষ্টিত এই ক্ষুদ্র দ্বীপ বনভোজন প্রেমী মানুষের কাছে এক অনন্য ঠিকানা হয়ে উঠেছে। কারন সুন্দরবনের মাধুর্য নিয়ে অবস্থান করলেও জলে কুমীর ডাঙ্গায় বাঘের ভয় বিন্দুমাত্র নেই বললেই চলে। নামমাত্র খরচে চলে আসা যায়। ভরা বর্ষা হোক কিংবা শীত, পিয়ালি দ্বীপের আকর্ষণই আলাদা। কলকাতা থেকে পিয়ালী দ্বীপের দূরত্ব মাত্র ৭৫ কিলোমিটার। আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগবে। শিয়ালদহ দক্ষিন শাখার বারুইপুর-গোচরণ পেরিয়ে আসতে হবে। শিয়ালদহ-লক্ষ্মীকান্তপুর-নামখানা লাইনে গোচরন, দক্ষিন বারাশত, বহরু, জয়নগর-মজিলপুর ষ্টেশনে নেমে বাস, অটো বা পার্সোনাল গাড়িতে পৌঁছে যাওয়া যায় পিয়ালী দ্বীপের নির্জনতায়।
পিয়ালি নদী পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার সুন্দরবনের জোয়ারি জলে পুষ্ট একটা শান্ত নদী। সুন্দরবনের বেশীরভাগ অঞ্চলটাই বিভিন্ন নদী জালের মতো জড়িয়ে রেখেছে। তেমনি পিয়ালি নদীও সুন্দরবনের বহিরাংশ থেকে প্রান্তদেশ পর্যন্ত গিয়ে সুন্দরবনের প্রধান নদী মাতলার সাথে মিশেছে। পিয়ালি নদী আদিগঙ্গা বা ভাগীরথীর শাখাপ্রশাখার ন্যায় সপ্তদশ শতাব্দীতে পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান করছে। এই পিয়ালি নদী তিলজলার বামনঘাটা থেকে প্রায় ১৪ কিমি দূরে একটি স্থানে বিদ্যাধরী নদী থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিম দিকে প্রাবাহিত হয়ে ক্যানিং সদর থেকে আরো ৩২ কিমি দূরে গিয়ে কুলতলা গাঙের মধ্য দিয়ে গিয়ে মহিষমারী, পচুয়াখালী, ডোঙ্গাজোড়া, কেল্লা, অম্বিকানগর,আঁধারিয়া হয়ে মাতলা নদীর সাথে মিলেছে। এর একটি শাখা আবার ঠাকুরান নদীতে গিয়ে মিলেছে। এখানেই তৈরি হয়েছে এই সুন্দর সবুজে মোড়া পিয়ালি দ্বীপ। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বঙ্গ অববাহিকার অবনমনের কারনে এবং পূর্ব দিকের ঢালের জন্য এইদিকে নদীগুলি এগিয়েছে। পরবর্তীকালে আদিগঙ্গা তার প্রবাহপথের দিক পরিবর্তনের সাথে সাথে এই পিয়ালি নদীসহ এইস্থানের সকল নদীতে ব্যাপক পরিমাণে পলি জমে স্রোতকে নিয়ন্ত্রন করে। পিয়ালির মিষ্টি জলের সাহায্যে আশেপাশে চাষাবাদে দারুন সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
যাইহোক আবার আসি আমাদের গন্তব্য পিয়ালি দ্বীপ তথা কেল্লার কথা। এহেন কেল্লায় একমাত্র থাকার জায়গা হল পিয়ালি আইল্যান্ড ট্যুরিস্ট লজ। এখানে ১৯টি ডবল বেডের রুম রয়েছে। থাকা আর খাওয়ার খরচ আলাদা। থাকা-খাওয়া মিলে মাথাপিছু প্রতিদিন ১২০০ টাকা পড়বে। মৎস্যপ্রেমীরা এখানে টাটকা মাছের স্বাদ নিতে পারবেন। সুন্দরবনের কাঁকড়ার স্বাদও মিলে যেতে পারে কপালগুনে।
কলকাতা থেকে সড়কপথে চলে আসুন পিয়ালি দ্বীপ। সুন্দরবনের অনেকগুলি প্রবেশপথের মধ্যে একটি হল পিয়ালি দ্বীপ। ছোট্ট শান্ত পিয়ালি নদী অনেকটা ঘুরে ঘুরে এখানে এসে মিশেছে মাতলার বুকে। আপনি পিয়ালি দ্বীপ থেকে নৌকো নিয়ে মাতলা নদীতে ঘুরে বেড়াতে পারেন। একটু সময় নিয়ে যাওয়া যায় কৈখালী, ঝড়খালি, ভরতগড়। ভোরবেলা উদিত সূর্যের আভা কিংবা রাতে জ্যোৎস্না পড়ে যখন চকচক করবে পিয়ালি নদীর জল, তখন তার রূপই আলাদা। নদীর ওপর দিয়ে বয়ে আসা শীতল বাতাস প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। আশপাশের সবুজ গাছগাছালিতে পাখিদের কার্যকলাপ আপনার নজর কাড়বে। শীতের দিনগুলিতে পিয়ালির চরে আপনার প্রতীক্ষায় পরিযায়ী পাখির দল। এখনও এখানে সেই আধুনিক সভ্যতার (?) মানুষের অকারনে বনভোজনের তাগিদে কোলাহল বা পরিবেশ দূষণের প্রভাব পড়ার মতো ঘটনা ঘটে নি।
যা পিয়ালি দ্বীপ নামে পরিচিত, তাই স্থানীয় ভাবে কেল্লা নামে সবাই জানে। এই কেল্লাতে এসে পিয়ালি নদী মাতলা নদীতে মিশেছে। ১৯৭২ সালে দু-পাশের গ্রামের কৃষির উন্নতির জন্য তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমলে একটি বাঁধ দিয়ে এই পিয়ালি নদীতে মাতলার নোনা জল ঢোকা বন্ধ করা হয়েছে। পিয়ালি আর মাতলার সংযাগস্থলে এই বাঁধের লাগোয়া জঙ্গলাকীর্ণ ছোট্ট একটি চরই এই পর্যটন কেন্দ্র। তখন অবশ্য এটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠেনি। সেই বাঁধ তৈরির সময়ে কাজ করতে আসা কর্মীদের জন্য PWD-র কয়েকটা পরিত্যক্ত ঘরবাড়ি ছিল মাত্র। অর্থাৎ সেখানে ঘুরতে যাওয়া মানুষজনদের জন্য থাকার কোনও জায়গা ছিল না। স্থানীয় মানুষের কথায় এই অঞ্চল একটা সময় পর্যন্ত সমাজবিরোধীদের আখড়া হিসাবে সবাই জানতো। খুন, রাহাজানি, ডাকাতি, লুটপাট সবই চলতো সময়ের নিরিখে। সময় বদলেছে, আর্থসামাজিক পরিকাঠামো পাল্টে দিয়েছে মানুষের মতিকে। মিশে গেছে জীবনের মুল স্রোতে সেদিনের দস্যুর দল।
এখানে বনভোজনের পাশাপাশি আপনার জন্য অপেক্ষমাণ ছোট ছোট ভুটভুটি নৌকা। তারা খুব কম প্যসার বিনিময়ে আপনাকে পিয়ালির চরে প্রতীক্ষারত পরিযায়ী পাখিদের দর্শন করাতে। আপনি পিয়ালি দ্বীপ বা কেল্লায় আসবেন অথচ নৌকা বিহার করবেন না তা হয়? নৌকা যত এগোবে আপনার অনুভূতির শিকড় ততই জোরালো হবে। মনে হবে সাগর সংগমে নবকুমার প্রসঙ্গের ন্যায় বলি যা দেখিলাম তা জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিব না। কেল্লার দক্ষিণ দিকে থাকে বড় বড় লঞ্চ, যা কিনা আপনাকে নিয়ে যাবে একটু দূরে মোহনা, কৈখালী, ঝড়খালিসহ সুন্দরবনের গভীরে। দু একদিনের যাত্রায় শীতের সকালে একটু উষ্ণতার খোঁজ নিতে আসতে পারেন দক্ষিণ ২৪ পরগণার উপেক্ষিত পর্যটন কেন্দ্র পিয়ালি দ্বীপ তথা কেল্লায়। অল্প খরচে, স্বল্প সময়ে কেল্লায় গেলে কেল্লাফতে। কারন সবকিছুর পাশাপাশি আপনার জন্যে ডোঙ্গারিয়া বাজারের লোকজন নলেনগুড়, জিরন কাঠের খেজুরের টাটকা রস সাজিয়ে বসে থাকেন। তাঁদের হয়তো শিক্ষা বেশী না, কিন্তু মানবিকতা অনেক বড়মাপের। আপনার এই দু একদিনের ভ্রমণ হয়তো তাঁদের বেশ কিছুদিনের দারিদ্র মোচন। চিন্তা নাই, পরিবর্তে আপনাকে পরিষেবা দিতে তারা নিজেদেরকে নিংড়ে দেবেই দেবে। ভালো থাকবেন।
রচনাকাল : ১৪/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।