‘জটার দেউল’-সুন্দরবনের প্রাচীন ভূগোল চর্চায় এক অন্যতম পুরাতাত্ত্বিক উপাদান
আনুমানিক পঠন সময় : ১৪ মিনিট

লেখক : সনৎকুমার পুরকাইত
দেশ : India , শহর : ডায়মন্ডহারবার

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , জুন
প্রকাশিত ৯৭ টি লেখনী ৩৮ টি দেশ ব্যাপী ৩৫১৯১ জন পড়েছেন।
Sanat Kumar Purkait
(রায়দিঘি শ্রীফলতলা চন্দ্রকান্ত উচ্চ বিদ্যালয়ে ভারত সরকারের মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইন্সটিটিউট অব্‌ এশিয়ান স্টাডিস কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে আমন্ত্রিত ‘জটার দেউল – ইতিহাসের এক বিস্ময়কর সৌধ’ শীর্ষক বিশেষ বক্তৃতার সারাংশ)
 
               সুধীভদ্র পঞ্চজন, সবাইকে সুপ্রভাত। আজকের এই মহতী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেয়ে নিজেকে ধন্য বলে মনে করছি আর ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি ভারত সরকারের MAKAIS এর কর্ণধার ও বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মহাশয়কে। সাথে সাথে মঞ্চে উপবিষ্ট অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকা, গুণীজনএবং আমার স্নেহের ছাত্রছাত্রীদের সবাইকে যথাযোগ্য স্থানে রেখে আজকের আলোচনা শুরু করছি। ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।
              
                আজকের আলোচনা চব্বিশ পরগণা ও সুন্দরবনের ইতিহাসের সাথে ভূগোলের মেলবন্ধনে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান তথা ইতিহাসের বিস্ময়কর সৌধ জটার দেউল। শুরুতেই আমরা একটু জেলার অবস্থানিক গুরুত্ব জেনে নেব। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা বা তৎকালীন অবিভক্ত চব্বিশ পরগণাসহ সমগ্র সুন্দরবনের ইতিহাস ও ভূগোল চর্চায় প্রাচীন পুরাতত্ত্ব বা পুরাতাত্ত্বিক উপাদান বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে। আমরা সুন্দরবন নিয়ে অনেক আলোচনা শুনি বা পড়ি, কিন্তু এই সুন্দরবনের প্রাচীনত্ব নিয়ে মানুষের মনে বিভিন্ন মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। সেই প্রাচীনত্ব বা ঐতিহাসিক সময়ে সুন্দরবনের ভূগোল চর্চা বা সমসাময়িক সময়ের সমাজব্যবস্থা বা সংশ্লিষ্ট এলাকার ভূ-প্রাকৃতিক চরিত্র কেমন ছিল তা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আমাদের সমাজবিজ্ঞানে ইতিহাসের সাথে ভূগোলের মেলবন্ধন ঘটানোটা জরুরী হয়ে পড়ে। তাই আমরা আজ ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখে নেব সুন্দরবনের পুরাতাত্ত্বিক উপাদানের কোথায় কোথায় এর ভূগোল চর্চা লুকিয়ে।

               নানা শিল্পদ্রব্য নির্মাণের সাথে সাথে এই জেলার বাণিজ্যেরও প্রসার হয়েছিল অতি প্রাচীনকাল থেকে। বানিজ্য দুরকম ছিলঃ অন্তর্বাণিজ্য (বাংলা ও ভারতের মধ্যে) এবং বৈদেশিক বহির্বাণিজ্য – সিংহল, সুবর্ণভূমি, সুমাত্রা, যবদ্বীপ প্রভৃতি পূর্ব এশিয়ার নানাস্থানে। আবার পশ্চিমে মিশর, গ্রিস, রোম, ভূমধ্যসাগরের ক্রিট দ্বীপেও। এসব বিবরণ পেরিপ্লাস গ্রন্থে (১ম শতক) ও টলেমীর বিবরণীতে(২য় শতক) পাওয়া যায়। অন্তর্বাণিজ্য জল ও স্থল উভয়পথেই হত। সরস্বতী, গঙ্গা, বিদ্যাধরী, যমুনা, ইছামতী প্রভৃতি নদী দিয়ে পণ্যদ্রব্য সারা বাংলা ও পূর্ব ভারতে ছড়িয়ে পড়ত। সেদিন এসব নদী কোলাহলে মুখরিত ছিল। প্রাচীন স্থলপথও অনেক। য়ুয়ান চোয়াং সপ্তম শতকে যে পথ দিয়ে সমতট থেকে ২৪ পরগণার ওপর দিয়ে তাম্রলিপ্তে আসেন সে পথে পূর্ববঙ্গে ও কামরূপে ২৪ পরগণার পণ্যদ্রব্য গরুর গাড়ি করে যেত, এতো অসম্ভব কল্পনা নয়। এছাড়া গঙ্গাতীর ধরে শ্রীচৈতন্যের নীলাচলে যাত্রার বহুজন লাঞ্ছিত প্রাচীন পথ যাকে আমরা দ্বারীর জাঙ্গাল বলে জানি সে পথও বানিজ্য পথ ছিল। এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় ইংরেজ আমলে যত রেলপথ হয়েছে সেগুলি অধিকাংশই প্রাচীন স্থলপথের ওপরেই নির্মিত। 

              সন্ধ্যাকর নন্দী রামচরিতে পালরাজধানী রামাবতীর বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখেছেন – ‘প্রশস্ত রাজপথের ধারে কনক পরিপূর্ণ ধবল প্রাসাদ শ্রেণী মেরুশিখরের ন্যায় প্রতীয়মান হইত এবং ইহার উপর স্বর্ণকলস শোভা পাইত। নানাস্থানে মন্দির, স্তূপ, বিহার, উদ্যান, পুষ্করিণী, ক্রীড়াশেল, ক্রীড়াবাপী ও নানাবিধ পুষ্প, লতা, তরু, গুল্ম নগরের শোভা বৃদ্ধি করত। হীরক, বৈদূর্যমণি, মুক্তা, মরকত, মাণিক্য ও নীলমণিখচিত আভরণ, বহুবিধ স্বর্ণখচিত তৈজসপত্র ও অন্যান্য গৃহোপকরণ, মহামূল্য বিচিত্র সূক্ষ্মবসন, চন্দন, কুমকুম, কর্পূরাদি গন্ধদ্রব্য এবং নানা যন্ত্রোত্থিত মন্ত্রমধুর ধ্বনির সহিত বিশুদ্ধ সঙ্গীত-রাগিণী নাগরিকদের ঐশ্বর্য, সম্পদ, রুচি ও বিলাসিতার পরিচয় প্রদান করিত।’ সাধারণ পরিচারিকাগণও মূল্যবান বস্ত্র ও অলংকারে ভূষিত থাকত। রামচরিতে সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা বঙ্গভূমির মনোরম বর্ণনাও আছে যার থেকে আমাদের চব্বিশ পরগণা তথা সুন্দরবন ব্যতিক্রম নয়।

             সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘বাঙালীর ইতিহাস নাই, কে লিখিবে? তুমি লিখিবে, আমি লিখিব, সবাই লিখিবে’। তাই ইতিহাস কথা বলে, দেখায় নতুন করে পথ চলার রাস্তা। কারণ, আমরা অতীতের অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ হয়ে বর্তমানের  আলোয় আলোকিত হয়ে ভবিষ্যতের পথে পাড়ি দিতে থাকি। প্রাচীনকাল থেকে যত সভ্যতা, সংস্কৃতি কালের প্রবাহে প্রবহমান হয়েছে তার ইতিহাস ধরা থাকে তাঁদের উপাস্য দেব বিগ্রহ, দেবদেউল, মন্দির, মসজিদ বা তার গাত্রে চিত্রিত নকশায়। ইতিহাসের এই সকল উপাদান কালের স্রোতে বিলীন হয়ে যাওয়া মানবসভ্যতার ভূগোলের উপাদানকে প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করে থাকে। আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় এমনি এক প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান তথা সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার প্রান্তীয় মথুরাপুরের রায়দিঘিতে অবস্থিত দীর্ঘদিনের পরিত্যক্ত এক দেউল বা মন্দির – ‘জটার দেউল’ কে নিয়ে। 

               জটার দেউল বা জটার শিব মন্দির বাঙালী ভ্রমণ পিপাসু মানুষের কাছে এক বিস্ময়ের বিষয়। মথুরাপুর অঞ্চলের রায়দিঘি অঞ্চলকে যদি সুন্দরবনের প্রবেশদ্বারগুলির মধ্যে একটি অন্যতম ক্ষেত্র বলে মনে করা হয় তাহলে তার মর্যাদা রক্ষার্থে প্রাচীন জটার দেউল এক অন্যতম সৌধ যা ভৌগোলিক, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের আড়ালে এক ঐতিহাসিক দলিলের নামান্তর। রায়দিঘিতে পর্যটক এলে জটারদেউল বিনা তার ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। যাইহোক, আমরা এই দেউল সম্পর্কে জেনে নেব আর সাথে সাথে ইতিহাসের সাথে ভূগোলের সম্পর্ক খুঁজে দেখে নেব। এই জেলার এক কৃতি সন্তান ঐতিহাসিক দুইধারার মধ্যে সম্পর্ক দেখাতে গিয়েসুন্দরভাবে বলেছেন, “কেবলমাত্র ভূ-তত্ত্ববিদগণ এ দেশকে নবীন বলিয়াছেন বলিয়া প্রাচীনকালে ইহার অস্তিত্ব ছিল না এরূপ স্থির করা আদৌ যুক্তিযুক্ত নহে। ভূ-তত্ত্ববিদগণ লক্ষ লক্ষ বৎসরের কথা বলেন, কারণ তাঁহাদের অনুসন্ধান ঐতিহাসিকদের ন্যায় পাঁচ সাত হাজার বৎসরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নহে। এ জন্য তাঁহাদের নিকট যে দেশ নবীন, ঐতিহাসিকদের নিকট তাহা বহু প্রাচীন।”

              আমাদের বর্তমান জেলা দক্ষিণ ২৪ পরগণার জন্ম হয় ১৯৮৬ সালের ১ লা মার্চ শনিবার, কিন্তু তার অনেক আগেই ১৭৫৭ সালের ২০ শে ডিসেম্বর অর্থাৎ পলাশীর যুদ্ধের প্রায় ৬ মাস পরে ২৪ পরগণার জন্ম হয়। মিরজাফর কলকাতা সহ দক্ষিনে কুলপি পর্যন্ত ২৪ টি পরগণার জমিদারি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ২২২৯৫৮ টাকা বার্ষিক খাজনা ও বাংলার নবাব হওয়ার আকাঙ্ক্ষায়। এই চব্বিশটি পরগণা হল যথাক্রমে আকবরপুর, আমিরপুর, কলিকাতা, পৈলান, আজিমাবাদ, বালিয়া,বারিদহাটি, বসনধোয়াব, দক্ষিণ সাগর, হাতিয়াগড়, গড়, ইখতিয়ারপুর, খাড়িজুরি, খাসপুর, মদনমল্ল, মাগুরা, মানপুর, ময়দা, মুড়াগাছা, পাটকুলি, সাতাল, শাহ্‌নগর, শাহ্‌পুর ও উত্তর পরগণা।

              প্রথমদিকে সুন্দরবনের অধিকাংশ ২৪ পরগণার মধ্যে ছিল না। ১৭৭০ সালে প্রথম জঙ্গল হাসিল করে সুন্দরবনে বসতি ও চাষ আবাদের কাজ শুরু হয়। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর উন্নয়নের স্বার্থে সুন্দরবনকে ২৪ পরগণার সাথে যুক্ত করা হয়। ১৮২২-২৩ সাল নাগাদ সমগ্র সুন্দরবনকে চাষাবাদের সুবিধার জন্য বিভিন্ন লট ও প্লটে ভাগ করেন। উত্তর দিকের সুন্দরবনকে ১,২,৩ করে মোট ১৬৯ টি লট বা লাট এবং দক্ষিণ সমুদ্রের দিকের এলাকাগুলোকে A, B, C থেকে L পর্যন্ত ১২ টি প্লটে চিহ্নিত করা হয়। ১৮৭১ সালে কলকাতাকে ২৪ পরগণা থেকে বাদ দিয়ে নতুন জেলার জন্ম হয়।  

               বাংলার প্রথম জরিপ হয় ১৫৮২ সালে সম্রাট আকবর ও আকবরের অর্থসচিব টোডরমলের আমলে। এই জরিপে বাঙলাকে ১৯ টি রাজস্ব অঞ্চলে ভাগ করেন যার মধ্যে একটি সাতগাঁ বা সপ্তগ্রাম ছিল। এর পূর্বে কপোতাক্ষ থেকে পশ্চিমে হুগলী নদী এবং উত্তরে পলাশী থেকে দক্ষিনে সাগরদ্বীপের হাতিয়াগড়। আমাদের ২৪ পরগণা ছিল এই সাতগাঁ সরকারের একটি অংশ। ১৭২২ সালে একবার এই পরগণাগুলিকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হলেও ১৮৫৫ সালে মহকুমার ধারনা নিয়ে সমগ্র জেলাকে মোট ৮ টি মহকুমাতে ভাগ করা হয়। নতুন মহকুমার সৃষ্টি আর প্রশাসনিক সুবিধার কারণে ১৯৮৬ সালের ১লা মার্চ শনিবার ২৪ পরগণাকে ভেঙ্গে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণাকে এই দুটি জেলায় ভাগ করা হয়। সুন্দরবন রয়ে যায় এই দুই জেলার দক্ষিণের প্রান্তবর্তী ব্লক হিসাবে।

              তা এই সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলের মধ্যে পরিত্যক্ত প্রাসাদ, মন্দির, সৌধের সন্ধান পাওয়া যায়। এমনি এক মন্দির হল তৎকালীন ২৪ পরগণার দক্ষিনাংশে মথুরাপুর থানার ১০০ ফুট উচ্চতার ওড়িশার রেখ দেউলের আদলে গঠিত জটার দেউল। আরকিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে পি. সি. মুখোপাধ্যায় সরেজমিনে তদন্ত করে এটিকে ‘Deul of Jatesvara Mahadeva’ বলে রিপোর্ট পাঠালেন। ১৯০৪-১৯০৫ এর সার্ভে রিপোর্টে মিঃ টি ব্লক এটিকে দশম শতকের মন্দির বলে রিপোর্ট পাঠালেন। Jatar Deul- “The Temple itself is a single tower built of brick. It stands on ancient mound. The accurate date of the temple is not known but it is certainly more than 500 years old. A copper plate of about 900 year old is said to have been found close to it several years ago but it is not known what has been become of it and it could not be traced.”

              আবার একটি হারিয়ে যাওয়া তাম্র পত্রিকার তথ্য থেকে জানা যায়, জটার দেউল ৮৯৭ শকাব্দ অর্থাৎ ৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে তৈরির কথা জানা যায়। এই পত্র থেকে জানা যায়, মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা রাজা জয়ন্ত চন্দ্র। একসময় জটার দেউল ঘন জঙ্গলে আকীর্ণ এবং শ্বাপদসঙ্কুল ছিল। এটি ১১৬ নং লটের অন্তর্ভুক্ত এবং কঙ্কনদিঘির পূর্বদিকে অবস্থিত। জটার দেউল মন্দিরের সন্নিকটে ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে জমিদার দুর্গাপ্রসাদ চৌধুরী জঙ্গল হাসিল করার সময় একটি তাম্রলিপি খুঁজে পান। এই লিপি মূলত সংস্কৃত ভাষায় হলেও কালিদাস দত্ত মহাশয় বলেছেন Epigraphia Indica, Vol-XXVII, 1947-48 এর ২৫ পৃষ্ঠায় এবং List of Ancient Monument in the Presidency Division পুস্তকেও এই তাম্রলিপির উল্লেখ আছে। নিম্নে সেই রিপোর্ট তুলে ধরা হল-“The Deputy Collector of Diamond Harbour reported in 1875 that a copper plate discovered in a place little to the north of JatarDeul fixes the date of erection of this temple by Raja Jayantachandra in the year 897 of the Bengali Sak era corresponding to A.D. 975. The copper plate was discovered at the clearing of the Jungle by the grantee Durga Prasad Chowdhury. The inscription is in Sanskrit and the date as usual given in enigma with name of the founder.”
১৯১৪-১৯১৫ সালে জে এফ ব্ল্যাকস্টোন এই মন্দির পরিদর্শন করেন। 

               ১৯০৭ সালে A.H. Long hurstএই এলাকা নিজে পরিদর্শন করে বলেন-“The only signs of a palace or fort were a rising mound of broken brick, earth and debris, over grown with grass and jungle, running east and west for a distance of about 250 yards and being roughly 40 yards in which at the highest end, which rises about 30 feet above the ground and shows traces here and there of a brick wall embeded in its surface which, however nowhere projects higher than few inches above the ground.”এইমন্দিরেরপাশাপাশিএকটি অসম্পূর্ণ তালিকা থেকে জানা যায়, দক্ষিণ ২৪ পরগণা থেকে প্রাপ্ত মূর্তির সংখ্যা প্রায় ৬৭ টি। আবার আর একটি তথ্য থেকে জানা যায় কালিদাস দত্ত কর্তৃক প্রাপ্তব্য মূর্তি প্রায় ২০০ এর বেশী হবে। এই মূর্তিগুলির মধ্যে ৩৪ টি প্রস্তর, ৪ টি ব্রোঞ্জের বিষ্ণুমূর্তি, নৃসিঙ্ঘ-৫, গরুড়-৩, কূর্ম-২, লক্ষ্মী-২, গণেশ-৭, জগদ্ধাত্রী-১, শিব-৪ টি। এছাড়াও ৭ টি বৌদ্ধমূর্তি, ৯ টি জৈনমূর্তি পাওয়া যায়। এসকল প্রাপ্য উপাদান থেকে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা আর মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস বা ধর্মাচরণের পদ্ধতি সম্পর্কে যেমন জানা যায় তেমনি সময়ের সাথে সাথে প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক বা আর্থ-সামাজিক কারণে কিভাবে সেই সমাজ ভিন্নধর্মী রাজরাজড়াদের হস্তক্ষেপে তা কিভাবে নষ্ট হয়ে গেছিল। 

                তাম্রশাসনে উল্লিখিত ‘জটার দেউল’ এই জেলা তথা বাংলার একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রত্নসম্পদ যা এখনও মাটির উপরে দাঁড়িয়ে আছে। রেখ শৈলীর স্থাপত্যের অনন্য সাধারন উদাহরণ এটি। তৎকালীন সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলের মধ্যে এইরকম একটি স্থাপত্যের নিদর্শন অনেকের কাছেই বিস্ময়ের কারণ। তাম্রশাসন অনুসারে এর প্রতিষ্ঠাকাল ৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে অর্থাৎ পালযুগের হলেও এর প্রকৃত প্রতিষ্ঠাকাল কাল নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। যেমন,নলিনীকান্ত ভট্টশালীর মতে এটির নির্মাণ মুঘলযুগে।কাশীনাথ দীক্ষিতের মতে, এর নির্মাণ দ্বাদশ শতাব্দীতে।সতীশচন্দ্র মিত্রের মতে, এই দেউল প্রকৃত পক্ষে রাজা প্রতাপাদিত্যের জয়স্তম্ভ এবং ১৬শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে নির্মিত।আবার অনেকে মন্দিরের নির্মাণ শৈলী বিচার করে বলেন এটি গুপ্তযুগের। আবার ১৮৫৭ সালে মন্দিরের নিকট একটি তাম্রলিপি থেকে জানা যায় ৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে জনৈক রাজা জয়ন্তচন্দ্র এই দেউল তৈরি করান।কিন্তু, এই তাম্রলিপি থেকে পরিষ্কার ধারনা হয় যে আজ থেকে ১০০০ বছরের বেশী সময় থেকে এই স্থানে জনবসতি ও তাঁদের কার্যকলাপ বিদ্যমান ছিল।

                মুসলমান যুগ শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত দক্ষিণবঙ্গের মন্দিরগুলির মধ্যে একমাত্র সুন্দরবনের এই জটার দেউল ও আশপাশের কয়েকটি প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর নিদর্শন নেই। ওড়িশার রেখশৈলীর মন্দির স্থাপত্যের এই অনন্য সাধারণ উদাহরণ শুধু দক্ষিণ ২৪ পরগণা নয়, দেশেরও একটি মূল্যবান প্রত্নসম্পদ। ভারত সরকারের পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ(Archaeological Survey of India) জটার দেউলকে সংরক্ষিত পুরাসৌধ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তবে এটি শিবমন্দির হিসাবে প্রচার পেলেও এটি আদৌ শিবের মন্দির কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। কেউ কেউ একে বিজয়স্তম্ভ বলে দাবী করেছেন তো কেউ আবার স্মৃতি সৌধ বলে মনে করেন। তবে শিবের মন্দির যে পূর্বদিকে মুখ হয় না সে বিষয়ে অনেকেই দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছেন। মন্দিরটি ২৫ ফুট × ২৫ ফুট মাপের একটি পাদশিলার উপরে অবস্থান করে। পূর্বদিকের দেওয়ালে একটি খিলানের ন্যায় প্রবেশদ্বার বর্তমান যেখান থেকে মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করা যায়, যা মাটি থেকে আরও গভীরে নেমে গেছে।

               জটার দেউল ও তার গঠনশৈলী সম্বন্ধে অনেকেই অনেক কিছু বর্ণনা দিয়েছেন। তবে অসীম মুখোপাধ্যায় তার চব্বিশ পরগণার মন্দির বইটিতে বলেন যে এই জটার দেউল মন্দিরটি বর্গাকার, খাড়াভাবে উপরে উঠে গেছে। উচ্চতা পড়ায় ১০০ ফুট। ওপরের অংশ ভাঙ্গা। ওড়িশার রেখদেউল বা রেখশৈলীর প্রভাব এতে পড়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত-“The temple (32th Square ground plan) rises straight from a low mound (about 2 m high). Its outer façade is broken into three different pilasters each of which is similarly treated. The main body is separated from the sikhara portion by three deep recesses and four sharp lines of projection. The doorway(16th high, 9ft 6 inch wide) faced east and was topped by a triangular corbelled arch.”
 
               ১৩১৪ সালে পণ্ডিত নকুলেশ্বর বিদ্যাভূষণের লেখা ‘কুমুদানন্দ’ নামে একটি ঐতিহাসিক উপন্যাসে জানতে পারা যায় যে, ১০০১ সালে সুন্দরবনসহ সারা দক্ষিণবঙ্গে ব্যাপক বন্যায় জলপ্লাবনের কারণে সারা সুন্দরবন জনশুন্য হয়ে পড়ে এবং দীর্ঘদিন ধরে গাছগাছালি বাড়তে বাড়তে সুন্দরবনের মত বিরাট জঙ্গলের অবস্থান তৈরি হয়। তার আগে পর্যন্ত এই সুন্দরবনের গভীর জঙ্গল অর্থাৎ বর্তমান আলোচ্য এলাকা সমৃদ্ধ জনবসতিপূর্ণ এলাকা ছিল। রাজা প্রতাপাদিত্যের আমলে এই অঞ্চল দারুণভাবে বিকাশলাভ করে। তাই সারা সুন্দরবন জুড়ে দেখা যায় অনেক আগেকার পাল বা সেন যুগের ঐতিহাসিক প্রত্নবস্তু এখানে সেখানে ছড়িয়ে থাকতে, ঠিক তেমনিভাবে গুপ্ত বা মুঘল যুগের অনেক নিদর্শন মেলে এই সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জঙ্গলের কিনারে। আগেই বলেই সাগরের সাথে মিশে ছিল আদিগঙ্গার শতমুখী ধারা। এখান থেকে বিদেশের সাথে সারা দেশের বানিজ্যতরী জলপথে আসাযাওয়া করত। সেইসুত্র ধরে মগ, পর্তুগীজ, ফরাসী জলদস্যুরা এইস্থানে আশ্রয় নিয়ে লুটপাট শুরু করে এবং তৎকালীন সমৃদ্ধ এবং শান্তিপূর্ণ জনসমাজে ভীতির সঞ্চার করে। ইতিহাসের অলিন্দ ধরে পিছিয়ে গেলে আমরা দেখতে পাব যে তৎকালীন সুন্দরবনের সামাজিক বা প্রাকৃতিক ভূগোলের ব্যাখ্যা খুব একটা খারাপ ছিল না।

                আমরা জানি যে, কলকাতার বুক চিরে আদিগঙ্গার মূলধারা দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বিভিন্ন জায়গা দিয়ে সুন্দরবনের উপর দিয়ে সাগরে মিশত। ১৭৭৬ সালের রেনেল সাহেবের মানচিত্র খুললে দেখা যায় যে, সুন্দরবনের বিস্তার একটা সময় কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম পর্যন্ত ছিল। কালের ক্রমবিবর্তনে মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদার সাথে সাথ মেলাতে গিয়ে মানুষ প্রকৃতিকে সংহার করতে করতে বর্তমান সুন্দরবনের উত্তরসীমাতে পৌঁছেছে। তাও পরিবেশ ও বনদপ্তরের লাল সতর্কবার্তায় বর্তমান সীমাতে নিয়ন্ত্রিত আছে। এই সুন্দরবনের উপর দিয়ে বারেবারে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বয়ে গেছে। ১৫৯৪ সালের বন্যায় এইস্থানের মানুষ একেবারের মত অন্যত্র চলে যান, কিন্তু তাঁদের রাখা বেশকিছু তাম্রফলকে লিপিবদ্ধ থাকে সেইসময়কার বিভিন্ন প্রামান্য নথি। বেশীরভাগ সম্পদ নষ্ট হয়ে গেলেও এই ধরনের মন্দির বা দেউলগুলি আজও অবিকৃত হয়ে মাথা উঁচু করে আছে। জটার দেউলের মত দেউলপোতা, পাথরপ্রতিমার বনশ্যামনগরে, সাগরদ্বীপের বেশকিছু মন্দির একসময় লক্ষ্য করা গেলেও আজ তার বেশীরভাগ অংশ ভগ্নপ্রায়। জটার দেউল বাইরের অংশ কিছুটা নষ্ট হলেও তার গর্ভগৃহ বা অন্দরের অনেকাংশ ভালো আছে। এই মন্দিরের অবস্থান থেকে এটা পরিষ্কার তৎকালীন মানুষের মনে ধর্মীয় ভাবধারা যথাযথ ছিল এবং রাজা জয়চন্দ্র তার প্রজাদের উদ্দেশে স্বাধীনভাবে পূজাঅর্চনা করার জন্য এই দেবদেউল বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করান।

               মজার বিষয় হল, এই দেবদেউল আবিষ্কার হয় অনেক পরে। কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসেসুন্দরবন যেহেতু বারেবারে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে এবং এই স্থানের উপর দিয়ে একাধিক সক্রিয় নদী প্রবাহিত ছিল তাই গঙ্গার পলিসমৃদ্ধ বদ্বীপ অঞ্চল হিসাবে সুন্দরবনের এই অংশ সুপরিচিত ছিল। শোনা যায়, উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি কোন সার্ভেয়র সার্ভে করতে করতে এই লতাগুল্ম দ্বারা ঢাকা পড়া মন্দিরের চুড়ায় হোঁচট খেয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হন। অর্থাৎ, বোঝা যাচ্ছে প্রায় ১০০ ফুট মতান্তরে ৬৫ ফুট উচ্চতার সৌধ বা দেউল পলি দ্বারা ঢেকে ছিল। এই স্থানের ভূমিরূপের এই যে বিকাশ বা সময়ের সাথে সাথে ভূমিরূপের বিবর্তন ভূগোলের গবেষকদের ইতিহাসের মানুষের কাছে ধরা দিতে বাধ্য করে। সেই সুউচ্চ পলি সমৃদ্ধ এলাকা আবার ক্ষয় পেতে পেতে আজকের এই অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। মন্দিরের চারপাশে বর্তমানে কোন জঙ্গল নেই। চারদিকে চাষের জমি আর কিছু দূরে বসতবাটি। বর্তমানে সেই পতিত মন্দির ভারত সরকারের পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ(Archaeological Survey of India) কর্তৃক রক্ষনাবেক্ষনের কারণে পর্যটক আসতে শুরু করেছে এবং মন্দিরের তকমা সাঁটিয়ে স্থানীয় মানুষের আবেগে ভক্তি সঞ্চার করে দেওয়াতে স্থানীয় মানুষ দায়িত্ব নিয়ে রক্ষা করে। আমাদের উচিত এই ধরনের সৌধ বা দেউল ইতিহাসের স্বার্থে টিকিয়ে রাখা দরকার। সবাইকে আবার ধন্যবাদ জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করলাম।

গ্রন্থসূত্রঃ
1. চট্টোপাধ্যায়, সাগর, ‘দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার পুরাকীর্তি’
2. চট্টোপাধ্যায়, সাগর, ‘একুশ শতকঃ ঐতিহাসিক জটার দেউল’
3. চৌধুরী, কমল, ‘চব্বিশ পরগণা (উত্তর, দক্ষিণ ও সুন্দরবন)
4. দাস, গোকুল চন্দ্র (সঃ)-‘চব্বিশ পরগণার আঞ্চলিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি’, কলকাতা, ২০০৯
5. পশ্চিমবঙ্গ, দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা সংখ্যা, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ২০০০
6. পুরকাইত, সনৎকুমার, ‘জটার দেউলঃ এক বিস্ময়কর মিনার’, পরিক্রমণ, ভূগোলবিভাগ, রায়দিঘিকলেজ, ২০১৫-২০১৬
7. পুরকাইত, সনৎকুমার, ‘ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে-একটি সমাজ বিজ্ঞানীয় অনুসন্ধান’ ৩য় সংখ্যা, ২য় বর্ষ, ভূগোল ও পরিবেশ, জুলাই-আগস্ট, ২০১৮ 
8. মণ্ডল, কালীকৃষ্ণ- ‘দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা-আঞ্চলিক ইতিহাসের উপকরণ’ নবচলন্তিকা, ২০০১
9. মিত্র, সতীশচন্দ্র, ‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’
10. রায়চৌধুরী, প্রসিত, ‘আদি গঙ্গার তীরে’, কলকাতা


রচনাকাল : ১৪/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Albania : 1  Cambodia : 2  Canada : 146  China : 11  France : 1  Germany : 2  Hungary : 1  India : 762  Ireland : 48  Japan : 36  
Malaysia : 1  Russian Federat : 9  Saudi Arabia : 1  Sweden : 11  Ukraine : 6  United Kingdom : 1  United States : 782  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Albania : 1  Cambodia : 2  Canada : 146  China : 11  
France : 1  Germany : 2  Hungary : 1  India : 762  
Ireland : 48  Japan : 36  Malaysia : 1  Russian Federat : 9  
Saudi Arabia : 1  Sweden : 11  Ukraine : 6  United Kingdom : 1  
United States : 782  
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
‘জটার দেউল’-সুন্দরবনের প্রাচীন ভূগোল চর্চায় এক অন্যতম পুরাতাত্ত্বিক উপাদান by Sanat Kumar Purkait is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৩৭৬৯৩২
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী