জীবন নদীর ধারা
আনুমানিক পঠন সময় : ৭ মিনিট

লেখক : সনৎকুমার পুরকাইত
দেশ : India , শহর : ডায়মন্ডহারবার

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , জুন
প্রকাশিত ৯৭ টি লেখনী ৪০ টি দেশ ব্যাপী ৩৭৩৭৭ জন পড়েছেন।
               স্থান আরোগ্য হসপিটাল। ১০৮ নং কেবিন। ভি.আই.পি. লাউঞ্জ। বেড এ শুয়ে আছে স্বরলিপি। কোন সাড়া নেই আজ তিনদিন ধরে। কেবলমাত্র শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে ধীর গতিতে। স্বরলিপি, মানে স্বরলিপি গাঙ্গুলি ওরফে লাবন্য। জনপ্রিয় অভিনেত্রী। বয়স পঁচিশ পেরিয়ে কয়েকমাস। অধিক মাত্রায় স্লিপিং পিলস সেবনের কারনে হসপিটালে ভর্তি। ডাক্তারবাবু বলে দিয়েছেন চার পাঁচ দিন একটু কেয়ার নিয়ে অবজারভেশনে রাখতে হবে। তার আগে কিছু বলা যাবে না। নায়িকা স্বরলিপি গাঙ্গুলির যারা একনিষ্ঠ ফ্যান তারা হাসপাতাল চত্বরে ভিড় জমিয়েছে। বেশ কিছু মিডিয়ার লোকজন সকাল সকাল হাজির হয়েছে এক্সক্লুসিভ নিউজ কভারের জন্য। কিন্তু, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কাউকে ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছেন না। এমনকি কোন ডাক্তার বা নার্স সুপারের অনুমতি ছাড়া কোন বাইট দিতে পারবে না। কারন বাড়ির লোকের কথায় লাবন্য এই সব অকারন প্রচারের আলোয় আসা পছন্দ করেন না। 
              লাবন্য তখন খুব ছোট্ট। বর্ধমানের প্রত্যন্ত গ্রামের সবুজে মোড়া আচ্ছাদনে এক মায়াময় পরিবেশের কোলে বেড়ে ওঠা শৈশবের দিনগুলি লাবন্যের কাছে ছিল এক স্বর্গীয় আভা। প্রকৃতির কোলে তিলতিল করে বেড়ে উঠছিল সেদিনের ছোট্ট লাবন্য। তারপর একদিন সময়ের হাত ধরে শুরু হল জীবন নদীর আবর্তে ঘুরপাক খাওয়ার কর্মকাণ্ড। বর্ধমানের এক গরীব মাষ্টারমশাই বাবার হাত ধরে ফুলের পাপড়ির মতো ভাসতে ভাসতে বাবার সঙ্গে স্কুলে যেত। পাড়ার সবাই তাকিয়ে থাকতো তার রূপ লাবন্যে। তার রুপের সাথে তাল মিলিয়ে জন্মলগ্নে নামকরণে দেরি করেন নি কন্যাবৎসল শুভময় গাঙ্গুলি। সেদিন শুভময় বাবু মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিলেন যে মেয়েকে তিনি স্কুল টিচার করে তুলবেন। সবকিছু সেই গতিতে ধাবমান ছিল। শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পণের সাথে সাথে লাবন্য তার রূপ লাবন্যের পাশাপাশি নাচে গানে পড়াশুনায় সবার নজর কাড়ল। অষ্টম শ্রেণীতে জাতীয় বৃত্তি পরীক্ষায় স্বর্ণপদক আসল। সর্বভারতীয় সঙ্গীত পরিষদের পঞ্চম বর্ষের পরীক্ষায় রবীন্দ্র সঙ্গীত ও ক্লাসিকাল মিউজিকে ডিস্টিংশান পেল। পাশাপাশি বেঙ্গল মিউজিক কলেজ থেকে নৃত্যে চতুর্থ বর্ষে একটুর জন্য ডিস্টিংশান হাতছাড়া হলেও পরীক্ষকদের নজর কেড়েছে। স্কুলে লাবন্য নামে সবাই একডাকে চেনে। স্কুলের কোন প্রোগ্রাম করার থাকলে আগে লাবন্যের ডাক পড়ত। এ নিয়ে শুভময়ের গর্বের শেষ ছিল না। স্কুল থেকেও বেশ কয়েকবার ব্লক, জেলা হয়ে রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে তাঁর আদরের দুলালী। সাফল্য সবক্ষেত্রে না এলেও সংখ্যাটা ফেলে দেবার মতো নয়। এ হেন লাবন্য মাধ্যমিক পরীক্ষায় দুর্দান্ত রেজাল্ট করে পাশের স্কুলে ভর্তি হতেই পূর্ণিমার চন্দ্রকলা কমতে কমতে ধীরে ধীরে অমাবস্যার ঘোর কালো অন্ধকার নামানোর সুত্রপাত হয়ে গেল। নতুন স্কুল, তার উপর রূপে গুনে আসামান্যা লাবন্য। স্বাভাবিকভাবে বন্ধুর সংখ্যা বাড়তে থাকল। এভাবে বেশ খুশিতে দিন কাটছিল। একদিন লাবন্য স্কুল থেকে ফেরার সময় প্রবল বেগে বৃষ্টি নামল। প্রতীম এর সাথে কাছেই একটি শেডের তলায় অপেক্ষা করতে লাগলো। প্রতীম হল লাবন্যের পাড়ার বখাটে ছেলে। এই স্কুলে সে আগে থেকে পড়ে। এখন তার দ্বাদশ শ্রেনি। লাবন্য ওকে দাদা বলে ডাকে। প্রতীমও ভালো ব্যবহার করতো। সেদিন মাথায় বদবুদ্ধি হাজির হল। লাবন্যকে প্রতীম বলতে লাগলো
-আচ্ছা লাবন্য তোমার এত সুন্দর রূপ লাবন্য, পড়াশুনায় ভালো। তুমি সিনেমায় নামছ না কেন? 
-সিনেমা! সে কি আমাদের মত গ্রামের মেয়ের কোন চান্স আছে? তাছাড়া সেখানে চান্স পেতে কত সুন্দর হতে হয়!
-তুমি জান না লাবন্য। তুমি কত সুন্দর! তুমি নিজেকে আয়নার সামনে কখনও দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখেছ? সিনেমায় নামতে গেলে যা যা লাগে সব গুণাবলী প্রয়োজন সবই তোমার মধ্যে আছে। বিশেষ করে তুমি যখন স্টেজে নাচ কর, তখন দর্শক পাগল হয়ে একদৃষ্টিতে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি তো ভাবি যে তুমি কেন এখানে পড়ে আছ!
এসব কথা শোনার পর লাবন্যের দেহে মনে রোমাঞ্চের বন্যা বয়ে গেল। গ্রামের সরল মেয়ে রুপালী পর্দার সোনালী নায়িকা হয়ে উঠবে। উহু, জাস্ট ভাবতে পারছিল না সেদিন। 
-তুমি জান, সিনেমায় নামতে গেলে কার সাথে যোগাযোগ করতে হয়? কি কি করতে হয় বল না প্রতীম দা।
-আমি সব বলবো। কিন্তু তার আগে তোমাকে একটা কথা বলতে হবে যে বাড়িতে কিছু বলা যাবে না। পুরোটা সারপ্রাইজ হবে। তোমার প্রথম সিনেমা দেখে তোমার বাবা মা অবাক হয়ে যাবে। কলকাতায় আমার এক দাদা আছে। সিনেমা জগতের অনেক স্টারদের সঙ্গে তার ওঠা বসা। আমি তোমার কথা বলে রাখব আর তোমাকে দেখলেই ওরা তো লুফে নেবে। তুমি কিন্তু পুরো বিষয়টা গোপন রাখবে।   
-কিন্তু, বাবা মা তো জানতে চাইবে। আমি কোথায় যাব? কি প্রোগ্রাম করতে যাচ্ছি-এসব তো জানতে চাইবে। তাছাড়া আজ পর্যন্ত আমার সব প্রোগ্রামে বাবা মা কেউ না কেউ গেছে আমার সঙ্গে!!!  
-তুমি বলবে, আমাদের স্কুলের একটা প্রোগ্রামের রিহার্সাল আছে। ফিরতে দেরি হবে। ব্যস।
অনেক কিন্তু কিন্তু ভাব নিয়ে পরিশেষে লাবন্য এক অজানা স্বপ্নের পথে পাড়ি দেবার সিদ্ধান্ত নিল। বাবা মা কে মিথ্যা বলে পূর্বনির্ধারিত সূচী অনুযায়ী স্টেশনে পৌঁছে গেল যেখানে প্রীতম আগে থেকে অপেক্ষা করছিল। লাবন্য যেতেই দুজনে কলকাতাগামী ট্রেনে চড়ে বসল। লাবন্যের বুকের মধ্যে একটা চাপা আতঙ্ক কাজ করছিল। যাইহোক দুপুরের দিকে কলকাতায় সেই দাদার বাসায় নিয়ে হাজির হল প্রীতম। বস্তির মধ্যে একটি ছোট্ট খুপচি ঘর। লাবন্য বুঝতে পারে সে ভুল করে ফেলেছে। কিন্তু আর ফেরার উপায় নেই। চুপচাপ মাথার মধ্যে প্লান তৈরি চলছিল আর চোখের কোন থেকে জল গড়িয়ে আসছিল। সেই সময় ভিতর থেকে তার ডাক পড়ল সিনেমাদাদার কাছে যাওয়ার। লাবন্য তখনও আশায় ছিল। কিন্তু, কোন কিছু বোঝার আগেই সেখানেই কয়েক মুহূর্তে শেষ লুট গেল তার ষোলটা বসন্ত পেরিয়ে যাওয়া গচ্ছিত ফুটন্ত নবযৌবনের রসকলি। যন্ত্রণাক্লিষ্ট চোখে তাকিয়ে দেখল লাবন্য, যাকে সে বিশ্বাস করেছিল সেও বাদ গেল না। লাবন্য হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো।
-ওরে পাগলী, কাঁদছিস কেন? সিনেমায় নামতে গেলে ওদেরকে খুশী করতে এসব সহ্য করতে হয়।
-আমাকে বাড়ি নিয়ে চল। আমি বাড়ি যাব। আমি মায়ের কাছে যাব। তোমরা খুব বাজে। 
মা মা বলতে বলতে লাবন্য অজ্ঞান হয়ে গেল। রাত্রে যখন চোখ মেলে তাকাল তখন দেখল এক আলো ঝলমলে সুন্দর ঘরে শুয়ে রয়েছে।
-আমি কোথায়? আমি বাড়ি যাব। আমাকে বাড়ি নিয়ে চল।
জলের গ্লাস হাতে এক বিশাল দেহের মূর্তিময় মানুষরূপী দেবতা এগিয়ে এলেন। 
-মা, তুমি অবশ্যই বাড়ি যাবে। আগে একটু সুস্থ হয়ে নাও। এই জলটা খেয়ে নাও। 
লাবন্য একটু সময় নিয়ে বুঝতে পারল সে কালের করাল গ্রাস থেকে আপাতত মুক্তি পেয়েছে। ধীরে ধীরে উঠে তার হাত থেকে জলের গ্লাস নিয়ে সমস্ত ঘটনা তাঁকে বলল। তিনি আবার ঘটনাচক্রে সিনেমা জগতের ডাকসাইটে অভিনেতা সুবিরেশ স্যানাল।  
-দেখ মা। যা হবার হয়েছে। এখন তুমি আমাকে তোমার বাড়ির ঠিকানা বল। তোমাকে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করি।
-না, আমি আমার সব শেষ করেছি নিজের ভুলে। বাবা মায়ের বিশ্বাস হারিয়েছি। আমি আর ফিরতে চাই না।
-মা রে, আমাদের এই জগত ভালো না। এখানে কাজ করতে পারবি না। অনেক সমস্যা হবে।
-আমার আর কি খারাপ হবে বাবু! আমার জীবনে কি আর আছে শেষ হবার? 
তার জিদের কাছে হার মেনে সুবিরেশ ভাবলেন, যে মেয়েটির রূপ গুন আর নাচে গানে পারদর্শিতা আছে যখন কাজে লাগানো যাক। সেইমতো কাজ শুরু করে দিল লাবন্য। কারন, সুবিরেশের ইন্ডাস্ট্রিতে বেশ সুনাম আছে। তাঁর কথা কেউ অমান্য করতে পারেন না। পর্দায় নতুন নামে পরিচয় এলো। স্বরলিপি গাঙ্গুলি। যেমন অভিনয় তেমনি গানের গলা নবাগতা নায়িকার স্বরলিপির। প্রযোজকদের ভিড় বাড়তে থাকে। একের পর এক ছবিতে সাইন করতে থাকে। জীবনে আসে নতুন মোড়। স্বরলিপি আজ স্টার অভিনেত্রী। নিজের সবকিছু হারিয়ে অনেক কিছু পেয়েছে। বাবা মাকে ছেড়ে পেয়েছে স্যানাল বাবুর মত মানুষকে। এখন তাঁর আলাদা ডুপ্লেক্স হয়েছে। বাড়িতে কাজের লোক আছে। ইচ্ছে থাকলেও বাবা মায়ের সামনে যেতে মন চায় নি। খ্যাতি তাঁকে বিড়ম্বনায়ও ফেলেছে। এখন আর আগের মতো যেখানে সেখানে যেতে পারে না। রাস্তার মোড়ে ফুচকা খেতে পারে না। সবার সাথে শপিং করতে পারে না। সেসব তবু মানিয়ে নিয়েছিল কর্পোরেট স্বরলিপি। সেদিন বিকালে যখন প্রিয়া সিনেমা হলের সামনে প্রীতমের সাথে আবার দেখা হল। স্বরলিপি সিটিয়ে গেল। প্রীতম কথা বলতে চেয়েছিল। লিপি কথা না বলে সোজা গাড়িতে গিয়ে বসেছিল। তার ঠিক সপ্তাহ খানেক পর থেকে স্বরলিপির ফোনগুলি ঘনঘন বাজতে থাকে। অজানা নাম্বার থেকে। সবার একটাই কথা ম্যাডাম ফাঁকা আছেন? এখন রেট কত নিচ্ছেন? স্বরলিপি ফোন স্যুইচ অফ করে রেখেছিল। কাজের মেয়েরা ল্যান্ডফোন টা সামলাচ্ছিল। এসব দেখে লজ্জায় ঘৃণায় অপমানে একসাথে একুশটি স্লিপিং পিলস খেয়ে গত সোমবার রাত্রে শুয়েছিল। তারপর সকাল থেকে সাড়া না পেয়ে হসপিটালে নিয়ে যায়। পুলিশে অ্যারেস্ট করতে সেই নাকি বলেছে, দিদির ফোন নাম্বার দিয়ে লোকাল ট্রেনের জানালার উপরে লিখেছিল, “বিনা পয়সায় সুন্দরী নায়িকার সাথে রাত কাটাতে চান? এখুনি নিচের নাম্বারে ফোন করুন”। তারপর থেকে ফোন আসতে শুরু করে। প্রশ্ন সেদিনের লাবন্যের সুখ আর আজকের স্বরলিপির সুখের নিউক্লিয়াস ভিন্ন চরিত্রের আর ভিন্ন মাত্রারও বটে। তাই আপনি ঠিক করুন প্রিয়জনের পরামর্শ ব্যাতিরেকে মরীচিকার পিছনে ছুটে নিজেকে শেষ করবেন নাকি আপনার জনের কাছে স্বল্প সুখে সুখী হবেন। প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই গল্পের কাহিনী ও সংশ্লিষ্ট চরিত্র সবই কাল্পনিক। ঘটনার মধ্যে কেউ যদি তাঁর জীবনের বাস্তব ছবি প্রতীয়মান হতে দেখেন তাহলে অনুগ্রহপূর্বক এড়িয়ে যাবেন।
---------------------

রচনাকাল : ১৪/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 4  China : 14  Germany : 2  India : 70  Russian Federat : 16  Saudi Arabia : 1  Ukraine : 3  United States : 58  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 4  China : 14  Germany : 2  India : 70  
Russian Federat : 16  Saudi Arabia : 1  Ukraine : 3  United States : 58  
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
জীবন নদীর ধারা by Sanat Kumar Purkait is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৪৮৫১২৫
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী