হঠাৎ আসা হাল্কা হাওয়ায় মাঝে মাঝে ছোট চারাগাছ কোন কারনে উৎপাটিত হয়ে যায়। কিন্তু সেই চারাগাছ কে যদি যত্নসহকারে পুনঃরোপন করা যায় তাহলে তার শিকড় এতটা গভীরে চলে যায় যে ঐ চারাগাছ মহীরুহে পরিনত হয় এবং প্রবল ঝড়ের তান্ডবেও তা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঠিক তেমনিভাবে, বর্তমান দিনে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক মধুর সম্পর্ক কোন ঠুনকো কারনে ভেঙ্গে যায়। কিন্তু ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে যদি সেই সম্পর্ক জোড়া লাগানো যায় তাহলে তা মধুর থেকে মধুরতম হয়ে ওঠে। দুনিয়ার কোন বাহ্যিক শক্তি সেই সম্পর্কের ভিত টলাতে পারে না। আনন্দ, সুখ, সহনশীলতা আর বিশ্বাসের স্তম্ভ পায় প্রেম। প্রগাঢ় হয় ভালোবাসা। পড়শীরা ইর্ষা করে, তাকায় আড়চোখে। পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভালোবাসায় তৈরি হয় ভক্তি। ভক্তিতে জাগ্রত হয় শ্রদ্ধা। আর শ্রদ্ধা হল ভালো সম্পর্ক এর চাবিকাঠি। কারন, শ্রদ্ধা ছাড়া ভালোবাসা দাঁড়াতে পারে না। আজ সবটাই অবিনাশের জীবনের ক্যানভাসে সত্যি হয়ে আঁকিবুকি টানছে আর অবিনাশ দক্ষিনের বারান্দায় বসে তারিয়ে তারিয়ে তা উপভোগ করছে। করবে নাই বা কেন? এই হৃদয়ে কম আঘাত বয়ে বেড়াতে হয়েছে গত চারবছর ধরে? সেই যন্ত্রনায় প্রলেপ দিতে না হয় একটু মৃদুমন্দ বাতাসে সুখস্মৃতি রোমন্থন করা। আসুন এবার আসল কথায় আসা যাক।
আরামকেদারায় বসে ছিল বছর তিরিশের সুঠামদেহী অবিনাশ। অবিনাশ দত্তগুপ্ত। অবিনাশের চুলগুলো হালকা উড়ছে। দুরে কোকিল ডাকছে। এখনো শীতের আভাস কাটেনি। তবে সেই কামড়ানো শীতের লেশমাত্র নেই। পটভুমি ডুয়ার্সের জঙ্গল মধ্যস্থিত জয়ন্তী নদীর তীরে ‘বনান্তে’ কটেজ বনবাংলোর বারান্দা। বেশ আয়েশ করে আরামকেদারায় বসে আছে অবিনাশ। অনেকদিন পরে সে জীবনে একটু স্থবিরতা পেয়েছে। পর্না স্নানে গেছে। সেই সুযোগে চার বছরের সাথী গোল্ড ফ্লেকের অগ্নিকুন্ডে গোপন পরিভ্রমন। কারন পর্ণা এগুলো একদম পছন্দ করে না। দীর্ঘ চার বছরের অভ্যাসকে আবার একদিনে হুস করে ভুলে যাওয়া যায় না। এটা তাদের দ্বিতীয় হনিমুন। ত্রিশটা বসন্ত পেরিয়ে আসা অবিনাশের জীবনে এযেন এক নব বসন্ত।
আজ থেকে প্রায় ছ’বছর আগে অবিনাশের সাথে পর্ণা সাতপাকে বাঁধা পড়েছিল। পর্ণা মানে শ্রীপর্ণা মজুমদার। উত্তর কলকাতার মেয়ে। বেশ বনেদী পরিবারের মেয়ে। হটাত করে একদিন অবিনাশের সাথে সিটি সেন্টারে একটা রেস্টুরেন্টে দেখা হয়েছিল। সেদিন সৌম্য কান্তি সুঠামদেহী অবিনাশকে দেখে শ্রীপর্ণার ভাল লাগা কাজ করলেও প্রেমে পড়ে যায় নি। মানে লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট নয়। সেদিন কলেজে না গিয়ে সিনেমা দেখার প্ল্যান ছিল তাদের। সেই আনন্দে সকাল সকাল শ্রীপর্ণা যথাস্থানে পৌঁছে গেলেও সুনন্দা অর্থাৎ শ্রীপর্ণার বান্ধবী সুনন্দা এসে পৌঁছায় নি। সুনন্দা খুব সুন্দরী সাদাসিধে মনের মেয়ে। সেই কোন ছোটবেলা থেকে সাউথ পয়েন্টে পড়ার সময় থেকে পরিচয়। তারপর থেকে তাদের বন্ধুত্ব একেবারে চিপকে থাকার ন্যায়। দুজনের মধ্যে অর্থাৎ শ্রীপর্ণা একটু ডাকাবুকো প্রকৃতির, সে তুলনায় সুনন্দা একটু লাজুক প্রকৃতির। যাইহোক মিনিট পনের অপেক্ষা করতে করতে শ্রীপর্ণা ভাবল দেখি তো সুনন্দার এত দেরি হচ্ছে কেন? একটু পরে সুনন্দার আসতে দেরি হচ্ছে দেখে একটা মেসেজ করতে যাবে বলে যেই ফোনটা বের করতে যাবে। দেখল ব্যাগে সেলফোনটা নেই! ভালো করে মনে করতে স্মরণ হলো স্নানে যাওয়ার আগে ফোনটা চার্জে বসিয়ে ছিল কিন্তু তাড়াহুড়োতে আর নেওয়া হয় নি। কিংকর্তব্য শ্রীপর্ণা উপায়ান্তর না দেখে অস্থির হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। কিন্তু তখনো পর্যন্ত রেস্টুরেন্টে ভিড় হয় নি। তাই সামনের টেবিলে বসে থাকা উদাসী অবিনাশের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলেছিল-
-এক্সিউজ মি। ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড। মে আই ইউজ ইউর সেলফোন? অ্যাকচুয়্যালি............।
-ওহ সিওর সিওর। প্লিজ ফিল ফ্রি টু............।
তারপর সেই ফোন থেকে শ্রীপর্ণা সুনন্দার ফোনে একটা তের সেকেন্ডের কল করেছিল। ভদ্রতার খাতিরে সেদিন শুধু মিচকি হাসি দিয়ে একটা শুকনো ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছিল অষ্টাদশী শ্রীপর্ণা। ব্যাস, এটুকুই। তারপর অবিনাশ ভুলে গেছিল সবকিছু। কিন্তু শ্রীপর্ণা! শ্রীপর্ণা ভোলে নি। ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারে নি। আজ কেন তার এমন হচ্ছে! স্কুল, কলেজে পড়ার সময় নানান ধরনের বন্ধুর সাথে আলাপ হয়েছে, কিন্তু তাদের কারুর জন্য এমন উচাটন অবস্থা হয় নি তো। তার উপর যে তার অপরিচিত, তার কারনে শ্রীপর্ণার এই ভাবান্তর কিসের লাগি! শ্রীপর্ণা মনে মনে নিজেকে জিজ্ঞেস করে তবে কি শ্রীপর্ণা তুমি প্রেমে পড়েছ? দেহে মনে কেমন এক শুন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। তার মনের মণিকোঠায় অবিনাশের জন্য কি যেন একটা ভালো লাগা কাজ করতে শুরু করেছে। এখানে অবিনাশ সম্পর্কে একটু পরিচয় দেওয়া দরকার। অবিনাশ দত্তগুপ্ত। নাগেরবাজারে বেশ পুরানো বনেদি পরিবারের এক শিক্ষক পরিবারের সন্তান। বয়স ছাব্বিশ বছর। সদ্য একটি চাকরী জুটিয়েছে। ভালো চাকরী, বেতনও লোভনীয়। শান্ত শিষ্ট অবিনাশ নিজের কাজের প্রতি দায়বদ্ধ হলেও নিজেকে সময় দিতে কখন বন্ধুদের সাথে কখনও নিজে নিজেই বেরিয়ে পড়ে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায়। সিনেমার প্রেক্ষাগৃহে বসে আজ শ্রীপর্ণা বড়ই উদাসীন। সুনন্দার মাথায় ঘুরপাক খায় এহেন উন্নত যৌবনের তরঙ্গায়িত ঢেউ সমন্বিত কুঞ্চিত কেশরাশির নিম্নে টিকালো নাকের উপর সোনালি ফ্রেমের চশমা আর গোলাপি ঠোঁটের মাঝ থেকে রূপালী রেখার ন্যায় বেরিয়ে যাচ্ছে জ্বলন্ত সিগারেটের প্রহেলিকা। আহা যতই ভাবে, ততই পাগল হয় মন। যতই লুকাতে চায়, ততই প্রকট হয়। ভুলতে চাইলে স্থান করে নেয় মননে। এ এক অদ্ভুত অনাবিল আনন্দে মন ভেসে যায়, কিন্তু কি করবে শ্রীপর্ণা! নানান কাজের ফাঁকে অবিনাশের মুখটা শ্রীপর্ণার মনের দর্পণে ভেসে উঠছিল বারেবার। সেদিন, মাঝরাত্রে সুনন্দাকে ফোন করে বলল-
-এই শোন না, তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। তুই কাল চট করে একবার সিটি সেন্টার চলে আয়। আমি কিন্তু অপেক্ষায় থাকব। ঠিক দশটায়। মিস করলে এক লাথি খাবি।
কোন প্রশ্ন করার আগেই ফোনটা ঝপাং করে কেটে দিল শ্রীপর্ণা। শ্রীপর্ণার এই অদ্ভুত আচরণের সাথে বাল্যবন্ধু সুনন্দা একেবারে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তাই শ্রীপর্ণা বলেছে মানে যেতে হবে সুনন্দাকে। এর বাইরে অন্য কোন কথা চলবে না।সারানিশি নিদ্রা, জাগরণ মিলিয়ে কাটল শ্রীপর্ণার। পরদিন সকাল সাড়ে নটার মধ্যে গিয়ে হাজির যথাস্থানে। সুনন্দা হাজির হতেই তার হাত থেকে ছোঁয়া মেরে ফোনটা নিয়ে কললিস্ট ঘেঁটে নিয়ে অবিনাশের সেল নাম্বারটা বের করে মনের মণিকোঠায় কপি করে নিয়ে ডিরেক্ট ডিলিট করে দিয়ে তারপর থামল। সুনন্দাকে বোকা বানাতে শ্রীপর্ণা বলে-
-ধুর, ভাবলাম তোর ফোনে ছবিটা আছে। কিন্তু এখানেও নেই। এই নে রাখ......।
-কোন ছবিটারে পর্ণা?
-বাদ দে। খিদে পেয়েছে। চল কিছু খাওয়া যাক।
খানিক সময় কাটিয়ে সারপ্রাইজ সাসপেন্স রেখে সেদিন শ্রীপর্ণা বেরিয়ে গেল। সুনন্দা আজ অন্য এক শ্রীপর্ণাকে দেখল। আগেই বলেছি তার নানান খামখেয়ালীপনাতে সে পরিচিত। সারাদিন মন উড়ুউড়ু করছে। একটা ভালো লাগার আনন্দে একাকী ছাদে গিয়ে হেডফোন কানে লাগিয়ে সবার অলক্ষ্যে সময় কাটিয়েছে আর সাতসমুদ্র পার করে ভুবনডাঙ্গার মাঠ পেরিয়ে হৃদয়পুর স্টেশনে নেমে যায় তার মন। বুকের মাঝে চলন্ত ট্রেনের ধুকপুক ধুকপুক করে হৃৎপিণ্ডের ওঠানামা অনুভব করেছে সে। যাইহোক সেই দিন গভীর রাতে সবাই যখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন, তখন নিজের মোবাইল থেকে ওই নাম্বারে প্রথম মেসেজ করে শ্রীপর্ণা। এরকম পরপর তিনদিন সৌজন্য মেসেজ পাওয়ার পর উল্টোদিক থেকে একটাই রিপ্লাই আসে।
-কে?
এতেই শ্রীপর্ণা বুঝে যায় অবিনাশ সাচ্চা ছেলে আছে। এর সাথে বন্ধুত্ব করা যেতেই পারে। তারপর মেসেজ, ফোনে কথা, চ্যাটিং, ফেসবুক, হোয়্যাটসঅ্যাপ ইত্যাদির মাধ্যমে আলাপ, প্রেম গড়িয়ে ভালো লাগা থেকে একেবারে ভালোবাসায় পৌঁছল। তারপর সময়ের স্রোতে ভেসে সেই ভালোবাসা ভালো বাসায় আশ্রয় দিল দুই প্রেমিকপ্রেমিকা কে। অবিনাশের হাত ধরা সদ্য গ্র্যাজুয়েট শ্রীপর্ণা আর পড়াশুনা বা চাকরীর চেষ্টা না করেই সংসারের সুখে ভেসে যেতে থাকে। দারুন প্রেম, ভালবাসার জোয়ারে ভেসে অফিসকে টাটা বাই বাই জানিয়ে দুজনে সোজা হিমাচলের মানালিতে মধুচন্দ্রিমায় নিশিযাপন করতেও ভোলে নি। দুই পরিবারের মধুর সম্পর্ক আর অবিনাশের সংসারে হাসিখুসিতে দিন কাটে। এভাবেই সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। ঘটনার ঘনঘটা দুবছর পর এক সোমবার সন্ধ্যায় যখন অবিনাশ অফিস থেকে বাড়িতে ফিরল। এমনিতে সময়ের সাথে সাথে অবিনাশের কাজের চাপ ও দায়িত্ব দুটোই বেড়েছে। তাই ফিরতে একটু দেরি হয়। কিন্তু আজ শরীরটা ভালো লাগছিল না বলে একটু আগেই বাড়িতে চলে এসেছে। বিয়ের পর প্রায় দুবছর কেটে গেছে। ভালবাসার রঙ একটুও ফিকে হয় নি, বরং তার প্রগাঢ়তা বেড়েছে। প্রতিদিনের ন্যায় সবকাজ ফেলে শ্রীপর্ণা এক গ্লাস জল নিয়ে অবিনাশের সামনে হাসিমুখে দাঁড়াল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে শ্রীপর্ণার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। অবিনাশ কোন কিছুই বুঝে উঠতে পারল না।
-কি হয়েছে পর্ণা? কোন সমস্যা? আমাকে বল? আমি তাড়াতাড়ি বাড়িতে আসায় তুমি কি খুশি হও নি?
শ্রীপর্ণা দৌড়ে এসে অবিনাশের বুকে চাপড়াতে লাগলো আর হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো। অবিনাশের কথা তার কানে যায় না। আবিনাশ বারবার জিজ্ঞাসা করায় তখন অবিনাশের জামাটা টেনে ধরে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল।
-এসব কি? তোমার জামায় সিঁদুরের দাগ কেন? তুমি তলে তলে এতদূর? তাই তো বলি হটাত আজ এত তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফেরা কিসের লাগি! সত্যি করে বল তুমি আজ অফিসে গিয়েছিলে তো? নাকি অন্য কোথাও.........। এইসব নানান কথা বলে শ্রীপর্ণা আবার ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছে। অবিনাশ নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ মনোরথে প্রত্যাবর্তন করে। কোন কথায় শুনতে চাইল না শ্রীপর্ণা।
-আমার মানুষ চিনতে এত ভুল হল! হায় ভগবান! আমি আর এক মুহূর্ত এ বাড়িতে থাকতে পারব না। আমি আজই মা’কে ফোন করে চলে যাব। বৃথা এ জীবন। কাউকে বিশ্বাস করতে নেই।
অবিনাশ মুহূর্তের মধ্যে বোকা বনে গিয়ে চুপচাপ সোফার উপরে বসে মাথা নিচু করে থাকে। এদিকে শ্রীপর্ণার চিৎকারে পাশের ঘর থেকে অবিনাশের বাবা মা এসে কারন জিজ্ঞাসা করলে শ্রীপর্ণা কিছুই বলে না। লজ্জায়, ঘৃণায়, অপমানে চোখ লাল হয়ে যেতে লাগলো। অবিনাশকে জানতে চাওয়ায় তখন অবিনাশ বলতে থাকে।
-আমার শরীরটা আজ ভালো যাচ্ছিল না বলে আমি অফিস থেকে একটু আগেই ফিরে আসি। বনগাঁ লোকালটা সামনে পেয়ে উঠে পড়ি। কিন্তু বিধাননগরে নামার সময়ে প্রচণ্ড ভিড় ছিল। আমার মনে হয় ঐসময় কোন মহিলা উঠতে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে তার কপালের সিঁদুরটা লেগে গেছে। সেটাই পর্ণা কোনভাবেই বিশ্বাস করতে চাইছে না।
সব কথা শোনার পর বাবা পাশের ঘরে চলে যায়। মা ধীরে ধীরে শ্রীপর্ণার পাশে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে বলতে থাকে, ‘মা, তোমাদের মধ্যে কোন বিষয়ে আমরা থাকি না। তবে আমার মনে হয় তোমার কোথাও বোঝার ভুল হচ্ছে। তোমার থেকে তো অবিনাশকে আমি একটু বেশিদিন চিনি। তোমরা দুজনে একটু শান্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বল। আমার মনে হয় ঠিক হয়ে যাবে।’ শ্রীপর্ণা কোন কথা না বলে মাথা নিচু করে গোঙাতে থাকে।
পরদিন সকালে উঠে শ্রীপর্ণা অবিনাশ ও তার বাবা, মাকে জানায় যে সে বাবার বাড়িতে চলে যেতে চায়। অবিনাশের বাবা শ্রীপর্ণার বাবার বাড়িতে ফোন করে ডাকেন। ঘটনা শোনার পরে শ্রীপর্ণার দাদা ব্যাপারটা হাল্কাভাবে নিলেও মা বিষয়টার গুরুত্ব বুঝে শ্রীপর্ণাকে নিয়ে যেতে চাইলেন। এত সুন্দর সম্পর্ক, সুখের সংসার সব তছনছ হয়ে গেল শুধুমাত্র নিমেষের সন্দিগ্ধতায়। বিনা ডিভোর্সে সেপারেশান হয়ে গেল দুজনের সাজানো বাগানের ফুটন্ত কলিদ্বয়।
সময়ের করাল গ্রাসে সকল স্মৃতি আজ বিভ্রম। শ্রীপর্ণা আর অবিনাশ আজ দুই মেরুতে অবস্থান করেও তাদের অন্তরের আত্মিক টান রয়ে যায়। সাময়িক রাগ আর অভিমানের কাছে প্রচ্ছন্ন থাকে তাদের অনাবিল প্রেমের আনন্দময় দিনগুলির সুখস্মৃতি। অনেক কষ্টের মধ্যে দিয়ে অবিনাশ বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে তার লাস্যময়ী চপলমতি প্রানাধিক প্রিয়তমা পর্ণা। পর্ণার জেদ আর উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে তৈরি হওয়া রাগের কাছে অবিনাশের প্রেম আর বিশ্বাস মাটিতে লুটিয়েছে। পরে মাঝে মাঝে হয়তো দুএকটা মেসেজ চালাচালি হয়েছে, কিন্তু দুজনের দীর্ঘদিন আর দেখা হয় না। শ্রীপর্ণার রাগ আর অবিনাশের অভিমান দুজনকে দুজন দূরে ঠেলে দিয়েছে। তাতে দুজনের দুরত্ব হয়তো বেড়েছে, সাথে সাথে অনুরাগ বেড়েছে। কারন তাদের একাকিত্বে সুখস্মৃতিগুলো ভিড় করেছে। যাইহোক, সময় এগিয়ে যায়। শ্রীপর্ণার দাদারা তাকে অবিনাশের কাছে ফিরে যেতে বলে। কিন্তু শ্রীপর্ণার মা শ্রীপর্ণাকে মাথায় তোলে।
শ্রীপর্ণা আবার পড়াশুনায় মন দেয়। চাকরীর প্রস্তুতি নিতে শিয়ালদহে রাইসের মেন ব্রাঞ্চে ভর্তি হয়। বাড়িতে প্রিপারেশন চলে আর রাইসের গাইড ও প্রিয়বান্ধবী সুনন্দার সহযোগিতায় স্কুল সার্ভিস কমিশনের একটা প্যানেলে জায়গা করে নেয় শ্রীপর্ণা। মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে। জীবন থেকে মানুষ জীবনের শিক্ষা গ্রহণ করে। সেদিন শনিবার শ্রীপর্ণা রাইসে গেছিল। তখনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আসে নি। কম্বাইন্ড কোর্সের পরীক্ষা দিতে গেছিল। ফেরার পথে শিয়ালদহ এসে দেখে কোন একটা স্টেশনে দুঘণ্টা অবরোধের জেরে ট্রেন ইরেগুলার চলছে। প্ল্যাটফর্মে উপচে পড়া ভিড়। যাইহোক, অনেক চেষ্টার পর শ্রীপর্ণা একটা ট্রেনে উঠতে পারল, কিন্তু নামার সময় যুদ্ধ করে নামতে হল। আজ রাইসের শেষ দিন। হাসিমুখ নিয়ে শ্রীপর্ণা বাড়িতে প্রবেশ করলে দাদা সুকোমল চমকে উঠলেও ঠাণ্ডা মাথায় তাকে কাছে ডেকে বলে, ‘তুই একবার নিজেকে আয়নার সামনে গিয়ে দেখ আর মাকে দেখা।’
-কেন রে দাদা? কি হয়েছে?
-যা তুই, নিজেকে নিজে দেখ। তারপর যদি কোন প্রশ্ন থাকে জিজ্ঞাসা করিস।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শ্রীপর্ণা। মাথার সিঁদুর কোন কিছুর সাথে ঘসা লেগে কপালের একদিকে লেপটে আছে। মাথার সামনের চুলগুলো এলোমেলো। শ্রীপর্ণা আর মা সবিতাদেবী নিরুত্তর। মনে মনে ভাবছেন। এমন সময় দাদা গিয়ে শ্রীপর্ণাকে বলে।
-তুই ভেবে দেখ। আজ চার চারটে বছর ধরে অবিনাশের মতো ছেলেকে যে কারনে এত কষ্ট দিয়েছিস সে যদি আজ তোর এইরূপ দেখে প্রশ্নবানে জর্জরিত করে তোর কাছে দেবার মতো কোন উত্তর নেই।
-তুই বিশ্বাস কর দাদা, ট্রেনে আজ......।
-জানি, সব জানি। শ্রীপর্ণা, বাইরের জগতটা এতটা সহজ নয় রে, যতটা তোরা ভাবিস ঘরে বসে। আজ বাইরে বেরিয়েছিস, তাই জানলি বলে। তোর এমন উত্তর আসছে। আজ থেকে চার বছর আগে ঠিক এমন পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছিল অবিনাশ। তুই তার কথা শুনতে চাস নি। তার মতো ছেলে বলে আজ চারবছর পেরিয়ে গেলেও সে বিয়ে করেনি বা ডিভোর্সের কথা বলে নি। এখনও সময় আছে, অবিনাশের সাথে কথা বলে ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে তার কাছে ফিরে যা।
শ্রীপর্ণা সারারাত দু চোখের পাতা এক করতে পারে না। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর যে বাড়িতে আজ আনন্দের জোয়ার বয়ে যাওয়ার কথা সেখানে কেমন একটা ছমছমে ভাব। শ্রীপর্ণা মোবাইলটা বের করে একেবার প্রথম থেকে অবিনাশকে পাঠানো মেসেজগুলো পড়তে পড়তে চোখের জল গড়িয়ে আসে। ঝাপসা হয়ে গেল দৃষ্টি। আর পড়তে পারছে না। একবার উঠে মায়ের ঘরের দরজা ঠেলে দেখে মা গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। নিজের জীবন নিজের ভুলে শেষ হতে দেবে না। আজ জ্ঞানচক্ষু খুলে গেছে শ্রীপর্ণার। আর তার মায়ের কথা মাথায় নেই। বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে দাদার কথাগুলো তার কানে বিঁধছে। নিদ্রাহীন রাত জেগে ভোর হবার আগেই শক্তহাতে ফোনটা হাতে তুলে নিল। রাগের জেরে যে নাম্বার ডিলিট করে দিয়েছিল, অনুরাগের বশে সে নাম্বার মনের কোনে প্রথিত হয়ে ছিল। চোখের কোন কেঁদে কেঁদে ভিজিয়েছে। আশঙ্কাও ছিল, অবিনাশ কি আর তাকে ফিরিয়ে নেবে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে নাম্বারটা ডায়াল করতে প্রথম কলেই অবিনাশ রিসিভ করে। যেন সে চারবছর ধরে ফোনের দিকে দিবানিশি তাকিয়ে বসে ছিল এই ভেবে-এই বুঝি পর্ণার ফোন আসে। ভালোবাসার গভীরতা না থাকলে এমন হয় না। অবিনাশের বিশ্বাস ছিল একদিন না একদিন পর্ণা তাকে ঠিক বুঝবে। সে একদিন তার কাছে ফিরে আসবে। ফোন রিসিভ করতেই শ্রীপর্ণা বলে ওঠে-
-অবিনাশ.........শশশশশশশ। কেমন আছো অবিনাশ!!! আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। দুজনে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে। তারপর সম্বিত ফিরলে শ্রীপর্ণা বলে-
- ‘অবিনাশ, তুমি আমায় নিয়ে চল তোমার কাছে। তোমার বুকে আমায় একটু জায়গা দাও। আমি তোমাকে নিয়ে বাঁচতে চায়। আই লাভ ইউ অবিনাশ। আই লাভ ইউ ভেরি মাচ।’
সবিতা দেবী মেয়ের কান্না শুনতে পেয়ে উঠে এসে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এগিয়ে এসে শ্রীপর্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। শ্রীপর্ণা মাকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে। নীরবে চোখের জলে বয়ান ভাসছে মা সবিতাদেবীর। পরদিন দাদা আর মায়ের সাথে শ্রীপর্ণা সোজা অবিনাশের বাড়িতে। শ্রীপর্ণা অবিনাশের বাবা মায়ের কাছে ক্ষমা চায়। তারপর তো আপনাদের তো শুরুতেই জানিয়েছি। ওরা এখন দ্বিতীয় হনিমুন করতে ডুয়ারসের জঙ্গলে। ওরা এখন আগের থেকে অনেক কাছের, অনেক আপন। আজ শ্রীপর্ণা বুঝেছে প্রকৃত সুখের চাবিকাঠি কোথায়? শ্রীপর্ণা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে সে চাকরীতে জয়েন করবে না। সংসারে থাকবে। অবিনাশের জন্য থাকবে। মাতৃত্বের স্বাদ নিয়ে নারীর পূর্ণতা আস্বাদন করবে। আর কোন ব্যাপারে অবিনাশকে সে জ্বালাবে না। শুধু প্রেম করবে সময় পেলে। এইজন্য মনে হয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলতেন, ‘দূরে না গেলে কাছে আসা যায় না।’ যেমনটা অবিনাশ ও শ্রীপর্ণার জীবনে ঘটেছে। আজ ওরা শক্তহাতে এই সম্পর্কের চারাগাছ নতুন করে রোপণ করেছে যা কেউ উপড়ে ফেলতে পারবে না। কারন সেখানে আছে শুধু বিশ্বাস, ভালোবাসা, সহনশীলতা আর পরস্পরের প্রতি পরস্পরের ভক্তি। চলুন এবার কেটে পড়ি, অবিনাশের সিগারেট শেষ আর পর্ণাও স্নান করে বেরিয়েছে। এবার কিন্তু সিক্তবসনা শ্রীপর্ণা পিছন থেকে অবিনাশ কে জড়িয়ে ধরতে পারে। আপনারা যারা আমার গুণমুগ্ধ পাঠক, তারা অন্তত চোখ বন্ধ করুন প্লিজ নইলে চলুন জয়ন্তী নদীর বুকে একটু হেঁটে আসা যাক। প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই গল্পের কাহিনী ও সংশ্লিষ্ট চরিত্র ও ছবি সবই কাল্পনিক। ঘটনার মধ্যে কেউ যদি তাঁর জীবনের বাস্তব ছবি প্রতীয়মান হতে দেখেন তাহলে অনুগ্রহপূর্বক এড়িয়ে যাবেন। ধন্যবাদ।
-----------------
রচনাকাল : ১৪/৬/২০২০
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।