এ্যারনের চুল
এ্যারনের চুল
মূল রচনা-রবার্ট মুনস
অনুবাদ-দেবমাল্য মুখোপাধ্যায়
সে অনেক অনেকদিন আগের কথা। অনেক অনেক দূরের এক দেশে ছিলো একটা ছোট্ট ছেলে। ছেলেটার নাম ছিলো এ্যারন। এ্যারন ছিলো খুউব ভালো একটা ছেলে। সে তার বাবাকে খুউব ভালোবাসতো। সবসময় তার বাবার মত হতে চাইতো। বাবা কত্তো বড়! কত্তো কিছুই না করতে পারে! আর কত্তো সুন্দরই না তার মাথার বড় বড় কালো কুচকুচে চুল – এ্যারন দিনরাত এগুলোই মনে মনে ভাবতো। রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে কতবারই না সে প্রার্থনা করেছে তার মাথায় যেন বাবার মতন লম্বা লম্বা চুল হয়। কিন্তু তা কি করে হবে! এ্যারন তো এখনও একটা ছোট্টবাবু। ছোট্টবাবুদের মাথায় কি কখনও বড় বড় চুল হয়? এ্যারনের মনে তাই অনেক দুঃখ! অনেক কষ্ট! হতচ্ছাড়া বাটকু চুল! তুই একদমই পচা!
তাই একদিন তাদের বাগানের ভেতর একটা জলপাই গাছের নিচে মনমরা হয়ে বসে ছিলো এ্যারন। বসে ছিলো আর ভাবছিলো তার দুঃখের কথা! হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। সে আনন্দে লাফিয়ে উঠলো। কি বুদ্ধি? কি বুদ্ধি? হুঁ হুঁ! সে তো যেন তেন বুদ্ধি নয়! এ্যারন তো অনেক চালাক। সে ভেবে বের করলো, আরে! চুল তো না কাটলেই হয়! তাই তো সে বড় হবে, বেড়ে উঠবে, এক্কেবারে বাবার সেই মস্ত চুলের মতন! আহা! নিজের বুদ্ধি দেখে এ্যারন মনের সুখে গেয়ে উঠলো,
শোনো সবাই শোনো,
একটা দারুণ কথা শোনো।
আমার নাম এ্যারন,
আজ থেকে সব জেনে রাখো
চুল কাটা মোর বারণ।
আমার নাম এ্যারন।
যেমন বুদ্ধি, তেমন কাজ! তো তাই হোলো। এ্যারন আআর চুল কাটলো না, আর তাই তার ছোট্ট ছোট্ট চুলগুলো মহা-আনন্দে বেড়েই চললো, বেড়েই চললো। এ্যারন তো মহাখুশী! শেষ পর্যন্ত তার বাবার মতন বড়বড় চুল তার এই হোলো বলে!
কিন্তু যেই না তার চুলগুলো অনেক বড় হয়ে গেছে, এ্যারন পড়েছে মহা বিপদে! বিপদ! কিসের বিপদ! বড় বড় চুলগুলো তো আর ওর কথা শুনছে না! চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াতে যেয়ে এ্যারন তাই পড়েছে এক মহা ঝামেলায়! সে যখনই চুলগুলো উঁচু কোরে আঁচড়াতে যায়, দুষ্টু চুলগুলো হয়ে যায় নিচু। আবার যখনই সে ওদের আঁচড়াতে যায় নিচু কোরে, হতচ্ছাড়া ওগুলো হয়ে যায় উঁচু। শুধু কি তাই! সে যখন ওদের এপাশ কোরে আঁচড়ায়, ওরা হোয়ে যায় ওপাশ, আর ওপাশ কোরে আঁচড়ালে ওরা হোয়ে যায় এপাশ! একি ভয়ানক ব্যাপার! রাগে দুঃখে বিরক্ত এ্যারন তাই যখন একদিন বাথরুমে তার চুলগুলো আঁচড়াচ্ছিলো, আর অবাধ্য চুলগুলো ওর কথা শুনছিলো না মোটেই, এ্যারন আর না পেরে চিৎকার করে বলে উঠলো, চুউউউউউউল...আমি তোমাকে ঘৃণা করি! ঘৃণা করি!
এই সেরেছে! যেই না এ্যারন এই কথাগুলো বলে উঠলো, চুলগুলো না খুউব কষ্ট পেলো! ওরা দুষ্টু হলে কি হবে, ওদেরও তো মন আছে! ওরাও কি কষ্ট পায় না? দুঃখ পায় না? এ্যারনের কথা শুনে তাই চুলগুলো মনের দুঃখে এ্যারনের মাথা থেকে পালিয়ে গেলো। এক লাফ দিয়ে বের হয়ে গেলো বাথরুম থেকে। এ্যারন তো অবাক! সে দৌড়ে ওদের পিছু পিছু সিঁড়ী দিয়ে নিচতলায় যেই নামলো, অমনি পড়ে গেলো মা’র সামনে।
এ্যাএএএরন! তোর চুল...তোর মাথা...টাক!!!! কি করেছিস্! কি হয়েছে এখনি বল্! – চোখ গোল করে চিৎকার করে বলে উঠলো মা।
বেচারা এ্যারন!
আমার চুল পালিয়ে গেছে, মা। আমি ওকে কষ্ট দিয়েছি তাই ও পালিয়ে গেছে! – ফিস্ফিসিয়ে বললো সে।
মা’তো অবাক। কিন্তু তিনি বুঝে নিলেন ব্যাপারটা। ওহ্ কি করেছিস্ বাছা! যা এক্ষনি ওকে নিয়ে আয়...যা...দেরি করিস না! কখনো কারো মনে কষ্ট দিতে নেই রে...যা ওকে এখনি নিয়ে আয়!
মা’র কথাগুলো শুনে খুব ভালো লাগলো এ্যারনের। সত্যি! কারও মনে কখনও কষ্ট দিতে নেই!
উচ্ছ্বসিত এ্যারন এবার ঘর থেকে বের হয়ে যেই না রাস্তায় এসেছে, অমনি সে মা’র চিৎকার ঘরের ভেতর থেকে – এ্যাএএএএরন! কোথায় গেলি! এখানে আয় শিগ্গির! তোর চুল...তোর চুল!
চুল! ঘরের ভেতর! কোথায়?
এ্যারন একদৌড়ে ঘরে ঢুকেই দেখতে পেলো মা তার ছোট্ট ভাইয়ের দোলনার পাশে দাঁড়িয়ে।
চুল কোথায় মা! – হাঁপাচ্ছে এ্যারন।
মা চুপচাপ ইঙ্গিত করলো এ্যারনের দু’বছরের ভাইটার দিকে।
এ্যারন এগিয়ে গেলো। একি! ওটা তার ভাই! ওর ভাইয়ের সারা শরীরে এত চুল কোত্থেকে এলো! ওহ্! এগুলো সেই দুষ্টু চুল। ওকে ছেড়ে এখন ওর ছোট্ট ভাইকে ধরেছে!
এত্ত বড় সাহস! এই বলে এ্যারন যেই না এগিয়ে গিয়ে চুলগুলোকে ধরতে যাবে, অমনি চুলগুলো ওর গোলগাল নাদুসনুদুস ছোট্ট ভাইটাকে ছেড়ে একলাফে এ্যারনের মাথায় উঠে ডিগবাজি খেয়ে দৌড়ে পালালো খোলা দরজা দিয়ে। এ্যারন এবার আর ভুল করলো না। সেও পরিমরি কোরে দৌড় লাগালো চুলগুলোর পিছু পিছু। ওদেরকে চোখের আড়াল হতে দেয়া যাবে না – নিজেকে বললো সে। বাগানের উপর দিয়ে সে চুলগুলোকে তাড়া কোরে দৌড়ুল বড় রাস্তাটার দিকে।
রাস্তায় বেশ মানুষ। বিকেলবেলা। সবাই হাঁটতে বের হয়েছে।
হঠাৎ মাঝবয়েসী এক ভদ্রমহিলার ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চিৎকার শুনে সেদিকেই এগিয়ে গেলো এ্যারন।
কি হয়েছে...কি হয়েছে!
চুউউউউল...ইইইই...আমার পেট...এত চুল...ওরা ঐ রাস্তা থেকে এদিকে এসে আমার পেটে লাফিয়ে পড়েছে...এখন ওখানেই বড় হচ্ছে...
ইয়াক্! কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে! – মনে মনে ভাবলো এ্যারন!
ওহ্! আমাকে বাঁচাও! এটাকে এখান থেকে যেভাবে হোক সরাও... – কেঁদে উঠলো ভদ্রমহিলা!
এ্যারন চিন্তা করলো একটু। তারপর তার স্বভাবসুলভ আন্তরিক ভঙ্গিমায় সে ভদ্রমহিলাকে জানালো চুলগুলোর সূক্ষ্ম অনুভূতির কথা। জানালো ওদের ঘৃণা করার পরিণতির কথা।
এই শুনে ভদ্রমহিলাও অকপটে বলে উঠলো – চুউউউউউউল...আমি তোমাকে ঘৃণা করি!
কষ্ট!
চুলগুলো তাই আবারও পালালো।
দৌড়ে এগিয়ে গেলো রাস্তা ধরে।
এ্যারনও দৌড়।
একটু এগিয়ে যেতেই এবার লম্বাচওড়া এক লোকের চিৎকার!
বাঁচাও বাঁচাও বাঁচাও!
কি হয়েছে আংকল! – এ্যারনের কৌতূহলী প্রশ্ন।
চুল! চুল! ওই রাস্তা দিয়ে ওগুলো দৌড়ে এলো...আর লাফিয়ে উঠলো আমার শরীরে...এখন আরও বড় হচ্ছে...
তাই নাকি আংকল! কোথায়? – নিষ্পাপ জিজ্ঞাসা এ্যারনের।
কোথায় আবার! – বিব্রত লোকটা। লজ্জা পাচ্ছে। আমার পেছনে...আবার কোথায়! – বিরক্ত হচ্ছে সে এবার! রেগে যাচ্ছে!
হুম! ব্যাপারটা তো খুব অদ্ভুত! – মনে মনে ভাবলো এ্যারন! কিন্তু এটাতে লজ্জা পাওয়ার কি হোলো সে বুঝে পেলো না!
ওটাকে সরিয়ে নিয়ে আমাকে বাঁচাও – আর্তনাদ লোকটার। প্রায় কেঁদেই ফেললো সে বুঝি!
আহ্ ভাববেন না মোটেই, আংকল! – আত্মবিশ্বাস ঝরে পড়ছে এ্যারনের কণ্ঠে! শুধু বলুন আপনি ওটাকে ঘৃণা করেন, ব্যস!
তাই নাকি! – অবাক লোকটা। আর দেরি না কোরে সে বলে উঠলো – চুউউউউউউল...আমি তোমাকে ঘৃণা করি!
ঘৃণা আর ঘৃণা! ওহ্! কী দুঃখই না চুলগুলোর!
তাই ওরা আবারও পালালো।
এ্যারন কিন্তু পিছু ছাড়েনি!
বড় রাস্তা ধরে সামনে এগিয়ে যেতেই এবার চাররাস্তার মোড়। এই সেরেচে! – ভাবলো এ্যারন! বিকেলের অফিস-ফেরা গাড়িঘোড়া সামলাতে শশব্যস্ত এক ট্রাফিক পুলিশকে দেখে সে এগিয়ে গেলো। 'বাঁচাও, বাঁচাও!' হ্যাঁ, বেচারা পুলিশভাই গাড়িঘোড়া সামলানো বাদ দিয়ে এখন নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত বটে!
খুক্খুক্ কাশি দিয়ে ইতস্তত ভঙ্গিমায় এ্যারন – ইয়ে মানে! ওটা আমার চুল!
- তোমার চুল বালক! এই চুল তোমার? তোমার এই চুল!
- জ্বী! – বিনীত এ্যারন!
- ওহ্! তোমার চুল! তোমার এই চুল কোত্থেকে এসে জুড়ে বসলো আমার মুখে! চিন্তা করতে পারো? আমার মুখেহ্! এখন আমি কি করে এই গাড়িঘোড়া সামলাই, তুমিই বলো তো! চুলগুলো গজাতে গজাতে আমার মুখ ভর্তি কোরে ফেলছে! ওহ্ বালক! কী ভয়ংকর অবস্থা!
হ্যাঁ! ভয়ংকর অবস্থা বটে! এ্যারন গুনছে – দশটা গাড়ি, নয়টা মোটরসাইকেল, আটটা ট্রাক, সাতটা বাস, পনেরটা বাইসাইকেল, দুইটা এ্যাম্বুলেন্স, তিনটা ফায়ার-ট্রাক আর একটা ট্রেন!
কী বিশৃঙ্খলা! তালগোল পাকানো অবস্থা!
সব তোমার চুলের দোষ! – গর্জে উঠলো দাড়িমোচওয়ালা পুলিশ!
জ্বী, মানে, আপনি শুধু বলুন ওটা পচা। শুধু বলুন আপনি ওটাকে ঘৃণা করেন! – মজা পাচ্ছে এ্যারন।
- তাই! – দাড়িগোফের জঙ্গল হতে সন্দেহের দৃষ্টি পুলিশভাইয়ের!
- আরে! বলেই দেখুননা! – মুচকি হাসি এ্যারেনের ঠোঁটে।
আর পুলিশভাই গর্জে উঠলো – ব্যাটা চুউউউউউল! আমি তোকে ঘৃণা করি!
তারপর যা হয় আর কি! মনঃক্ষুণ্ণ চুল আবার পালিয়ে গেলো। এবার ওটা দৌড় দিয়ে হারিয়ে গেলো সেই গাড়িঘোড়ার হযবরল’র মধ্যে।
নাআআ! – আর্তনাদ কোরে উঠলো এ্যারন। এবার বুঝি সে সত্যিই হারালো তার চুলগুলোকে!
ঠিক এই সময় ইয়া মোটা আরেকজন পুলিশ এগিয়ে এলো ওদের দিকে! ভুঁড়ি নাচছে তার!
- এ্যাই কি হচ্চে এখানে! আমি বলি হচ্চেটা কি! – রাগী মোটা গলা তার। এখানে এত জ্যাম বাঁধিয়ে রেখেচে কে! আর ঐ পাথরের মূর্তিটার উপর ঐ চুলগুলোকে কে বসিয়েচে!
পাথরের মূর্তি! – অবাক হোলো এ্যারন। ওর চোখ চলে গেলো চার রাস্তার মাঝখানে ঐ পাথরের মূর্তিটার দিকে। ওটাকে নিয়ে কতবারই না বন্ধুদের সাথে মজার মজার খেলা খেলেছে সে!
ওহ্! তুই ওখানে উঠে বসে আছিস! দাঁড়া...এই তোকে মানে মানে ধরছি বলে! – এক দৌড়ে এ্যারন উঠতে শুরু করলো মূর্তির গা বেয়ে। কিন্তু যেই না উপরে উঠে ও চুলগুলোকে ধরতে যাবে, অমনি চুলগুলোর লাফ।
বাহ্! লাফাতে তো খুব ওস্তাদ দেখি তোরা! – রাগে গা কাঁপছে এ্যারনের।
চুলগুলোর পিছু পিছু সে আবার দৌড়ে ফিরে এলো ওদের দোতলা কাঠের বাড়িটাতে। কিন্তু বাড়িতে এসেই চুলগুলো একেবারেই হাওয়া হয়ে গেলো। কী অদ্ভুত! এ্যারন আর ওদের খুঁজে তো পেলোই না, পেলোই না!
মনের দুঃখে মনঃক্ষুণ্ণ এ্যারন তাই তার টাক মাথা নিয়ে নিজের ঘরে এসে বসলো।
সন্ধ্যা হোলো।
রাত্রি এলো।
চুলগুলো আর এলো না।
ওরা যে বড় দুঃখ পেয়েছে!
সবাই যে ওদের ঘৃণা করে!
রাতের খাবার সময় হোলো। বিষণ্ণ মনে বাবা-মা’র সাথে খাওয়ার টেবিলে আনমনে খাবার নাড়াচাড়া করতে করতে টেকো-মাথার এ্যারন খুব দুঃখ নিয়ে ধীরে ধীরে বলে উঠলো – ওহ্! আমি কি সারাজীবন এই টেকো-মাথা নিয়েই বেঁচে থাকবো! আমার চুল! আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে আমার চুলগুলো এখন ফিরে আসুক। আমি যে ওদের খুব ভালোবাসি!
আহ্! ভালোবাসা! শব্দটা শুনেই যাদু হোলো।
কি যাদু! কি যাদু!
এ্যারনের মুখ দিয়ে যেই না শব্দগুলো উচ্চারিত হোলো, অদ্ভুতভাবে এ্যারনের সামনেই বসে থাকা বাবা’র মাথায় লুকিয়ে থাকা চুলগুলো ভাতের থালা, মুরগীর মাংস, সালাদের বাটি, ডালের হাড়ি টপ্কে এ্যারনের মাথায় এসে চুপটি কোরে বসে পড়লো।
অদ্ভুত অনুভূতি হোলো এ্যারনের!
দারুণ! – গভীর মমতায় কথাগুলো বলে উঠলো সে। এবার শুধু যদি আমার মুখে একটু দাড়ি হোতো...আমি একদম বাবা হয়ে যেতাম!
তবে তাই হোক বাছা! – বলে উঠলো বিদগ্ধ চুলগুলো।
আর ওরা আস্তে আস্তে নেমে এলো। নেমে এলো এ্যারনের চিবুকে। জুড়ে বসলো। জুড়ে বসলো একগোছা দাড়ির মতন।
এ্যারন তাকিয়ে আছে। সে এখন তার বাবার মতন!
রচনাকাল : ১২/৬/২০২০
© কিশলয় এবং দেবমাল্য মুখার্জী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।