ভৌতিক ট্রেন
দেবমাল্য মুখোপাধ্যায়
(১)
পাহাড় ঘেরা একটা ছোট্ট গ্রাম। গ্রামের নাম কনকপুর। এই গল্পটা আমি শুনেছিলাম কনকপুরের স্টেশন মাস্টার অবিনাশ বাবুর কাছ থেকে। নমস্কার আমার নাম অনিকেত চট্টোপাধ্যায়। আমি ছিলাম কনকপুরের ব্যাংকের ম্যানেজার। রোজ রাতে আমাদের আড্ডা বসত। সেখানেই এই গল্পটা শুনেছিলাম।
একদিন আড্ডা মারতে মারতে রবিন বাবু হঠাৎ বলে উঠল, আপনার কোনো ভৌতিক ট্রেনের অভিজ্ঞতা আছে অবিনাশ বাবু। অবিনাশ বাবু বলল, তা আছে। এই কনকপুর স্টেশনেই আজো ঠিক রাত বারোটার সময় একটা ট্রেন আসে। কিন্তু সেই ট্রেনে কোনো মানুষ চড়ে না। কতগুলো আবছায়া সেই ট্রেনে চড়ে। আমি বললাম, কিন্তু এরকম কেন হয়। আমার কথা শুনে অবিনাশ বাবু বলল। তাহলে শুনুন সেই কাহিনী। বলে অবিনাশ বাবু তার কাহিনী শুরু করল।
(২)
সালটা 1944 একদল ইংরেজ এই ট্রেনে করে ফিরছিল। সেই খবর টা আগে থেকেই স্বদেশি যোদ্ধাদের কাছে ছিল। স্বদেশি যোদ্ধারা লাইনে আগে থেকেই ডায়নামাইট ফিট করে রেখেছিল। ঠিক তখন রাত বারোটা। ট্রেন টা সবেমাত্র ঢুকছে এই কনক পুর স্টেশনে। হঠাৎ একটা আওয়াজ। আর তারপরেই সমস্ত ট্রেনে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে লাগল। ওইদিন না হলেও প্রায় 250 জনের মত লোক মারা গেছিল।সেই থেকে আজও ওদের অতৃপ্ত আত্মা এই স্টেশনের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। আর স্থানীয় লোকদের ভয় দেখায়। আমি বললাম এখানে ঘুরে বেড়ানোর জায়গা কিছু আছে। অবিনাশ বাবু বলল না সেরকম কোনো জায়গা নেই। তবে কিছুদুরে একটা কবরস্থান আছে। ওখানেই এদের কে কবর দেওয়া হয়েছিল। তাই রাত হলে কেউ আর ওদিকে যায় না। আমাদের মধ্যে সেদিন ছিল কনকপুরের অবসর প্রাপ্ত ব্যাঙ্ক ম্যানেজার সুকান্ত ঘোষাল। তিনি সব শুনে বললেন। আমার জীবনে ঘটেছিল। আমি পড়েছিলাম ভূতদের পাল্লায়। এই বলে সে সেই কাহিনী শুরু করল।
(৩)
তো সেদিন ব্যাঙ্ক থেকে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেছিল। আমার কোয়াটারের আগে পড়ে সেই কবর স্থান টা। এমনিতেই আমি সাহসী। কিন্তু সেদিন কেন জানি না ভীষণ ভয় লাগছিল। তার উপর আকাশে কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। ঘনঘন বাজ পড়ছে। আর তার সাথে ঝোড়ো হাওয়া। কিচ্ছু চোখে দেখতে পাচ্ছি না। তার উপর ধুলোর ঝড়। কোনোরকমে হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে গেলাম। হঠাৎ একটা কিছুতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। পকেটে টর্চ ছিল। উঠে জামাকাপড় ঝেড়ে টর্চ টা কোনোরকমে বার করে দেখি একটা কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। ঠিক সেই সময় দূরে কোথাও একটা বেড়াল ডেকে উঠল। কোনোরকমে রামনাম করতে করতে কবরের থেকে বেরোতে যাব। হঠাৎ দেখি পিছন থেকে কে যেন টেনে ধরেছে আমার পা। পিছনে ফিরে দেখি একটা পচগলা হাত এসে আমার পা টেনে ধরেছে। আর কবর টা আসতে আসতে পরিণত হচ্ছে একটা স্টেশনে। ঘড়িতে দেখি রাত বারোটা বাজে। হটাৎ ট্রেনের আওয়াজে সম্বিৎ ফিরল। দেখি আমি রেললাইনে শুয়ে আছি। আর একটা কয়লার ইন্জিন আমার দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসছে। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই।
(৪)
যখন জ্ঞান ফিরল। তখন দেখলাম হাসপাতালে শুয়ে আছি। সারা গায়ে ব্যান্ডেজ। তখনও এই স্টেশনের মাস্টার ছিলেন অবিনাশ বাবু। অবিনাশ বাবু বললেন হ্যাঁ সুকান্ত বাবুর সেই ঘটনার আমিও ছিলাম সাক্ষী। তো জ্ঞান ফিরতেই দেখি সবাই আমায় ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। আর গ্রামের প্রবীণ পঞ্চানন রায় বলছে যে আপনাকে বারণ করা সত্ত্বেও কেন গেছিলেন ওখানে। আজ আপনার ভাগ্য ভালো যে রতন বাগদী দেখতে পেয়ে আপনাকে নিয়ে আসে। তাই আজ আপনি বেঁচে গেলেন। আর কোনোদিন ওই দিকে যাবেন না। আমি বললাম ঠিক আছে আর কোনোদিন যাব না। সেই থেকেই ওই কবর খানার রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
রচনাকাল : ১১/৬/২০২০
© কিশলয় এবং দেবমাল্য মুখার্জী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।