সাইলেন্ট রিডার
আনুমানিক পঠন সময় : ২০ মিনিট

লেখিকা : অস্মিতা ভাদুরী
দেশ : India , শহর : Konnagar

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , জুন
প্রকাশিত ১৪ টি লেখনী ৩২ টি দেশ ব্যাপী ৮০৮৩ জন পড়েছেন।
সাইকেলের চেন টা আবার পরে গেল। উফঃ কিযে রাগ হচ্ছেনা নিজের ওপর। মা অনেকবার বলেছিল সন্ধের আগে ফিরতে, সেও তো তাই চেয়েছিল। কিন্তু এভাবে যে তার প্রিয় গিয়ার সাইকেল টাই তার সাথে শত্রুতা করবে তা তো আর জানতনা। এই জন্যই  এই গ্রাম গঞ্জে আসতে একটুও ভালোলাগে না তমোঘ্নর।কিন্তু পূজো পার্বণে এই বাড়িতে না এলে মায়ের চলবেনা। তাই পৌষলক্ষী পূজার জন্য মা বাপি কাল ই এসে গেছে মুক্তাপুরে, আজ এসেছে সে।   আকাশে চাঁদ উঠে গেছে। সারাদিনের ঘাঁটাঘাঁটিতে ফোনের চার্জ ও শেষ। তা নাহলে এতক্ষনে মায়ের ফোন এসে যেত কতবার। সাইকেল টা হ্যাঁচড়াতে  হ্যাঁচড়াতে নিয়ে যেতে লাগল সে। এবার শীত টা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। তারওপর এই গ্রামে সন্ধে 7টা মানেই নিঝুম।রাস্তাঘাট শুনশান। আজ লক্ষ্মী পুজোর জন্যই তাও দু একজন রাস্তায় আছে।নয়তো এরকম হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় কারোর থাকার কথাই নয়। তবু এতক্ষন মেন রাস্তা ধরে চলছিল বলে একটু দোকানের আলো, লোক জন চোখে পড়ছিল, এবার ডানদিকের গ্রাম্য রাস্তা ধরতেই সেসব ও আর নেই। এত গাছপালার ফাঁকে যেটুকু চাঁদের আলো আসছে ওটাই সম্বল তমোঘ্নর। ডান দিকের রাস্তা টা  ধোপার মাঠ হয়ে যায়। কোনকালে  কে কেন কোন ধোপার জন্য এই ধোপার মাঠ নাম দিয়েছিল কেউ জানে না, তবে অদ্ভুত নামটা এখনো বেশ চলছে। এসব ভেবেই হাসি পেল তমোঘ্নর। ধোপার মাঠের আগেই পড়বে খ্রিস্টান কবরখানাটা। ছোটবেলায় কি ভয়টাই না পেত সে ওই জায়গা টা পেরোতে।দিদি তো এখনো ভয় পায় এখান দিয়ে যেতে। দিদিটাও না ! একটুকরো হাসি ফুটল তার মুখে। কবরখানাটা পেরিয়ে ধোপার মাঠে পড়ল সে। একবার চেষ্টা করল সাইকেলের চেনটা যদি ঠিক করা যায়। নাঃ, হলনা। এগোলো আবার। 

মাঠটার শেষে খালের ওপর দিয়ে সাঁকো পেরোতে হবে একটা। আগে বাঁশের সাঁকো ছিল। এখন কংক্রিটের। সেটা পেরোতে গিয়ে তমোঘ্নর মনে হলো সাঁকোর নীচে খালের জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ছাড়াও আরও একটা আওয়াজ হচ্ছে। সাথে একটা উৎকট গন্ধ। বমি পেয়ে গেল তার। ব্যাপার টা স্বাভাবিক মনে হলোনা। চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। ক্লাস ইলেভেনের সায়েন্সের ছাত্র তমোঘ্নর ভয় নেই কিছুতেই। না ভুত, না মানুষ। নিজের বাইসেপসের ওপরও যথেষ্ট ভরসা আছে। তাই সাইকেল টা সাঁকোর বামদিকের গার্ডার এ হেলান দিয়ে রাখল আস্তে করে।একটু পিছিয়ে এসে বামদিকে কয়েক পা হেঁটে নিচু হয়ে ঝুঁকে উকি মারল সাঁকোর নীচে। প্রায়ান্ধকার জায়গাটায় চাঁদের হালকা আলোর সাথে আরো একটা আলোর আভা। 

আগুন। না, লেলিহান শিখা নয়, গনগনে উনুনের আঁচের মতো আগুন। একটা কি পাত্রে রাখা আগুন টা। আর তার ওপর রাখা কালো কালো কিছু টুকরো। বেশ বড় সাইজের। পাশে গুটি সুটি মেরে বসে আছে কেউ বা কিছু, ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা। কালো কম্বলে সারা শরীর ঢাকা। শুধু চোখ গুলো জ্বলজ্বল করছে। বাদিকে কিছু একটা জড়ো করে রাখা। প্রায় হাত দশেক দূর থেকে এর চেযে বেশি কিছু বোঝা যাচ্ছেনা। তবে ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয়। এমন সময় আচমকাই কম্বলে মোড়া প্রাণী টা নড়ে উঠলো। মাথা থেকে ঢাকা খুলে গেল। মানুষ ই তো ! তবে এভাবে এখানে ?

এসব চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল তার যখন দেখল কম্বলের ভিতর থেকে উকি মারল বছর পাঁচেকের একটি পুচকে মানব শরীর। উৎকট গন্ধের উৎস ওই গনগনে আঁচের ওপর থেকে একটা বড় কালো টুকরো তুলে নিয়ে কচর মচর করে খেতে শুরু করল সে।

কিছুটা আঁচ করতে পারল তমোঘ্ন। কিন্তু বিশ্বাস হলনা। হঠাৎ শুনল সেই বাচ্চাটার কন্ঠস্বর " ই টা মোটেক সিদ্দ লয়, তুর টা দেহি ! "  বলেই কম্বলে ঢাকা মানুষটার হাতে থাকা টুকরোটা নিয়ে খেতে শুরু করল বাচ্চা টা। লোকটা ঠোঁটের ওপর আঙ্গুল দিয়ে চুপ করে থাকতে ইশারা করল বাচ্চাটিকে। চলতে লাগলো কচর মচর করে খাবার পর্ব।আগুনের ওপর রাখা টুকরো গুলো শেষ হবার আগেই কম্বলে ঢাকা লোক টা একটা বড় ছুরি জাতিয় কিছু দিয়ে পাশে রাখা জিনিসটা কাটতে লাগল। কালচে কিছু একটা খালের রুপালি জলে গিয়ে মিশল। 
আঁচ করা বিষয়টা সত্যি মনে হতে লাগল তমোঘ্নর। দেখল একটা করে টুকরো কাটছে আর আগুনের ওপর পুড়তে দিচ্ছে লোক টা। আর বেশ কিছুটা পুড়ে গেলে দুজনে মিলে খেয়ে নিচ্ছে। আবার কাটছে , আবার পোড়াচ্ছে... আর থাকতে পারলনা তমোঘ্ন। 

আস্তে আস্তে উঠে পড়ল। নিঃশব্দে সাইকেল টা নিয়ে এগোলো বাড়ির পথে। কিছুটা যাওয়ার পর মুক্তাপুর বাজার। যদিও এই রাতের বেলা সেটা অন্ধকার, তারপাশেই "উন্মুক্ত পাঠাগার"। রাত আটটা নাগাদ বন্ধ হয়ে যায় সেটাও। এখন আন্দাজ নটা সাড়ে নটা বাজে, তাও ভিতরের করিডোরে আলো জ্বলছে, মেন গেটেও তালা নেই। যাঃ বাবা ! এরকম তো হয়না ! ঢুকতে গিয়েও ঢুকলনা সে। বাড়ির পথেই এগোলো। এসব নিয়ে ভাবার এখন ইচ্ছাও নেই তার। বাড়ি গিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে ঐ ঘটনা টা। দিদিকে বলতেই হবে। আরও কিছুটা গিয়ে গঙ্গার পাড়ে শ্মশান। সেখান থেকে বাদিকে কিছুটা এগোলেই তমোঘ্নর বাড়ি। হাঁটতে হাঁটতে শুনতে পেল পিছন থেকে সাইকেলের ঘন্টি। এতরাতে এখানে কে ?পিছন ফিরে দেখতে পেল একটা লোক সাইকেলে করে আসছে, বেবিসিটার এ একটা বাচ্চা বসে সোয়েটার টুপি পরে। তমোঘ্ন পাশে সরে গেল। সাইকেল আরোহী তাকে পেরিয়ে এগিয়ে গেল। আচমকাই সেই উৎকট গন্ধটা পেল তমোঘ্ন। কিন্তু মাথা ঘামানোর আগেই দেখলো লোকটি তাদের বাড়িতেই ঢুকছে। তারাতাড়ি ঢুকলো সেও।

 তাকে দেখেই মা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবে এটাই ভেবেছিল তমোঘ্ন। কিন্তু সেরকম কিছুই হলোনা। মায়ের পুজোপাট, রান্না সব ই শেষ। তাকে দেখেই কথাদেবী মানে তমোঘ্নর মা বলে উঠলেন " এত দেরি হল কেন রে তোর ?জানিস পাশের বাড়ির বিমল দাদুকে আজ বিকেল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না ! তবে এটাই প্রথম নয়। মাস কয়েক ধরে প্রায় ই এই চত্বরের অনেকেই হারিয়ে যাচ্ছে। তাই তো তোকে বলেছিলাম তাড়াতাড়ি আসিস। কিন্তু জানি তো তুই আমার কথা শুনবি না। তাই আর কিছু বলেও লাভ নেই। তবে কি জানিস তো যারা হারিয়ে যাচ্ছে তাদের ক্ষত বিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে এখানে ওখানে। বেশিরভাগ পাওয়া যাচ্ছে কবরখানা পাশের জঙ্গলে, ধোপার মাঠের খালে, লাইব্রেরির পিছনের ছোট খালে, গঙ্গার পাড়ে। কিন্তু এরকম করে মারাই বা যাচ্ছে কেন আর মৃতদেহ এত খুবলে খাচ্ছে কিসে ? মুখ মাথা পুরো থাকে, আর বাকি শরীর নাকি থাকেনা। শিয়াল কুকুর তো এত বাদ বিচার করে খাবেনা ? আর তারা এক রাতে এত টা খাবেও না। এতদিন তো থেকেছি গঙ্গার পাড়ে, তখনও তো জলে মড়া ভেসে আসত, কই এরকম করে তো কেউ খেত না ? "  কথা দেবীর গলায় উদ্বেগ স্পষ্ট।  পরিবেশ হালকা করতে কথা ঘোরালো তমোঘ্ন। বললো " কাকে পাওয়া যাচ্ছে না ? ওই পাগলা বুড়ো কে ? ও তো পটি ম্যান ! হা হা হা "   কিন্তু কথাদেবী ছেলের হাসিতে মোটেই যোগ দিলেন না। বললেন "আরে বয়স্ক মানুষ একটু খিটখিট করতেন, আর সবসময় সামলাতে পারতেন না, কাপড়ে চোপড়ে করে ফেলতেন। তাই বলে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না আর তুই হাসছিস ?" বিপদ বুঝে তমোঘ্ন বলল " মা প্রসাদ  দেবে না ? বেশি করে তিলের নাড়ু, ক্ষীরের নাড়ু আর নারকেল নাড়ু দিও আমাকে !"  ছেলের আবদারে হাসলেন কথাদেবী, তিনিও জানেন তার ছেলে মেয়ে জামাই সবকটা ই নাড়ুর ভক্ত। 
প্রসাদ খেতে খেতে তমোঘ্ন জিগ্যেস করল " আচ্ছা মা, আমাদের বাড়ির নিচের তলায় বিল্টু রা ছাড়া আর কেউ নতুন ভাড়া এসেছে ? আমি ঢোকার সময় দেখলাম একটা লোক আর একটা বাচ্চা। সাইকেলে এলো।"  কথা দেবী বললেন " হ্যাঁ,ওনারা পুজোর পরেই এসেছেন। ওই যে বাপি একদিন একা এসেছিল না এখানে ? সেদিন কথা বলে পেপার রেডি করতেই তো এসেছিল।"  তমোঘ্ন বলল " তা ওরা কে কে আছে ?"     উত্তর পেল "ওরা কি কথা ? ওনারা বল। এই লাইব্রেরির যিনি লাইব্রেরিয়ান ছিলেন ওই যে রে অমল জ্যাঠা উনি রিটায়ার করেছেন, তাই ইনি ওই পোস্ট এ জয়েন করেছেন।"  চমকে উঠলো তমোঘ্ন। কথাদেবী বলেই চললেন " ওনারা তিনজন। স্বামী, স্ত্রী, ছেলে। জানিস বাবু ওনারা না সাঁওতাল বা অন্য কোনও আদিবাসী সম্প্রদায়ের। ভাষা বুঝবি ই না। একটু আমাদের মতো, তবে কিছু কিছু ভাষা পুরোই আলাদা। আর সারাদিন ঘর বন্ধ করে থাকে। বউ ,বাচ্চা কাউকে বেরোতে দেয় না। তবে বউটা দ্বিতীয় বউ জানিস ওই লোকটার ! আগের বউটা নাকি কিভাবে মারা গিয়েছিল, একে আবার বিয়ে করেছে। জল আনতে গিয়ে বিল্টুর মাকে বলেছে বউটা। ওদের অবস্থা ভাল নয় গরিব, তাই ওর বাবা দোজবরেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। যতই হোক সরকারি চাকরি করা পাত্র,  হোক না মেয়ের দ্বিগুণ বয়সী , তাতে কি ? তাই না বল ? "  বলে তিনি মুচকি হেসে তমোঘ্নর দিকে তাকাতেই দেখলেন সে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তারই দিকে। কারন জিগেস করতে তমোঘ্ন বলল একটু আগে দেখা ঘটনা টার কথা, আর তার মনে আসা সম্ভবনার কথা। 

রাতে ফোনে দিদিভাই আর জিজুকে সবটা জানালো সে। কাল তাদের আসতে বলল মুক্তাপুরে।শনি রবি তো দুজনেরই ছুটি। আজ তো সবে বৃহস্পতিবার। কাল অফিস সেরে দুজনেই আসতে পারবে। রাজি হলো দুজনেই। তবে মাকে জানাতে না করল। সারপ্রাইজ ভিসিট হবে এটা। 

 পরেরদিন হইচই শুনে ঘুম ভাঙল তমোঘ্নর। বারান্দা থেকে উকি মেরে দেখল কাল রাতে মা যাদের কথা বলছিল তাদের বাড়ির সামনে জটলা, কান্না, গুঞ্জন।মা বাপিও সেখানেই। অগত্যা চটিপায়ে হাজির হলো সেও। যাওয়ার আগে ওই বাড়ির গেটেই দেখা হল বিল্টুর সাথে। সমবয়সী বলে বিল্টুর সাথে খুব ভাব তমোঘ্নর। ওর কাছেই জানতে চাইল ঘটনা টা। শুনে চমকে উঠল সে। 
"কাল দুপুরের পর থেকে পাওয়াই যাচ্ছিল না বিমল দাদুকে। একটু ছিটগ্রস্ত থাকায় প্রায় ই এরকম এখান সেখান যেত আবার সন্ধের ভিতর ফিরে আসত। তাই কাল ও সবাই ভেবেছিল সন্ধের ভিতর ঠিক ই চলে আসবে। কিন্তু সন্ধে গড়িয়ে রাত হলো, তাও এলো না দেখে এদিক ওদিক খুঁজে ওনার ছেলেরা পুলিশে খবর দেয়। আজ ভোরে একজন মাছ বাজারে যাবে বলে স্টেশন এ যাচ্ছিল, পথে ধোপার মাঠের পাশের খালে একটা খুবলানো ডেডবডি দেখতে পান। পাশের ক্লাবের ছেলেদের ডাকেন। তারাই ওই সব দেখে পুলিশে খবর দেয়। এরকম কদিন ধরেই হচ্ছে এখানে জানিস তমো ? তারপর পুলিশ এসে বডি তুলতে দেখা গেল ওটা বিমল দাদুর ই বডি। মুখে চোখে একটু আঁচড় আছে তবে চেনা যাচ্ছে, কিন্তু বুকে পিঠে একটুও মাংস নেই। পাঁজরের হার গুলোও ভাঙা। যেন কেউ বুকের মাংস পুরো খুবলে তুলে নিয়েছে, বাকি শরীরেও খুবলানো।  এখানে ওখানে খুবলে খুবলে খাওয়া। তবে আরও একটা জিনিস পুলিশ পেয়েছে সাঁকোর নীচে, একটা বড় মাটির সরার ওপর পোড়া কাঠ কয়লার টুকরো। কে জানে ওগুলো কিসের ?" 
  সব শুনে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলনা সে, বলে ফেলল কাল রাতের অভিজ্ঞতা। শুনে বিল্টু ঢোক গিলে বলল " একদম চুপ, পুলিশের সামনে মুখ খুললেই কেস খাবি, যা দেখেছিস ভুলে যা।"   তমোঘ্নর বাবা জয়জিৎ বাবু ইতিমধ্যেই তাদের পিছনে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন, তিনি বললেন " একদম না, সত্যি টা সবার জানা দরকার, তবে হ্যাঁ, জনসমক্ষে নয়, ইন্সপেক্টর বাবুকে আলাদা করে বলতে হবে পুরো ব্যাপার টা। স্বভাবগম্ভীর জয়জিৎ বাবুর এমন বক্তব্য শুনে হা হয়ে রইল বিল্টু ও তমোঘ্ন।  

 সেদিন সন্ধে 7টা নাগাদ মেঘলা পৌছালো নীলপুর স্টেশনে। নেমেই শুনল কাল রাতের ঘটনায় সবাই এতই ভয় পেয়েছে কোনো কিছুই ওই রাস্তায় চলছেনা। ভাইটা আনতে আসবে বলেছিল, ওই না করেছিল। এখন ভাবছে কেন বারণ করল। ওই অন্ধকার কবরখানা পাশ দিয়ে একা হেঁটে যেতে হবে ওকে ? ফোন করলো ভাই কে, সুইচ অফ। মাকেও ফোন করতে পারছেনা। এত প্লান ভেস্তে যাবে। বিভোর মানে বরও আসবে রাত করে, অফিস থেকে সোজা গাড়ি নিয়ে। এখন সে কি করবে ? কাল ভাই এই রাস্তা দিয়েই গেছে, ওই সব দেখেছে, আজ যদি আবার ? ভাবতেই ভয়ে গলা শুকিয়ে গেলে তার। কি আর করবে, সুনসান রাস্তা, এমনি তেই নিঝুম এলাকা, সকলেই আজকের ঘটনার পর আরো চুপচাপ হয়ে গেছে। তাও সাহস করে এগিয়ে চলল। হাতের ব্যাগটা তেমন ভারী নয়, কিন্তু অন্ধকারে ওই কবর খানার পাস দিয়ে ? চমকে উঠল মেঘলা ফোনের রিংটোনে, তমোঘ্ন ফোন করেছে, খুশি হয়ে ফোন টা ধরতেই শুনল " দিদি তুই লাইব্রেরি তে গিয়ে বোস, বাড়ি আসিস না, আমিও যাচ্ছি ওখানেই। জলদি যা।"  কোনো ভূমিকা ছাড়াই কথাগুলো বলে ফোন কেটে দিল তমোঘ্ন। রাগে গা টা জ্বলে গেল মেঘলার। যাব্বাবা ! আমি কোথায় আছি না আছি না জেনেই আদেশ ? হঠাৎ শুনল পিছন থেকে  গাড়ির আওয়াজ। পিছনে তাকিয়ে দেখল স্কুটি। ওর পাশে এসে থামল। হেলমেট খুলতে দেখল ওরই  ছোট বেলার সহপাঠী বান্ধবী । ছোটবেলায় এরকম নামের জন্য খুব রাগাত ওরা বান্ধবীকে। কিন্তু আজ মনে হোল ও সত্যিই বান্ধবী। নইলে এরকম পরিস্থিতিতে ওই বা আসলো কেন ? বান্ধবী হেসে বলল " কিরে হেটেই যাচ্ছিস তো ? ওঠ গাড়িতে। দেখলাম আমি। আমি দোকানে কেনাকাটা করছিলাম। একা হেঁটে যাচ্ছিস দেখলাম, আবার মনে পড়ল তুইতো কবরখানা খুব ভয় পাস, হাহা হাহা, তাই তোকে পৌঁছে দিতে এলাম। নে  ওঠ।"  অন্যদিন হলে এই অপমানের পর ঝেড়ে ঝগড়া করত বান্ধবীর সাথে। কিন্তু আপাতত সেই পরিস্থিতি নেই। ঝগড়া মুলতুবি রেখে উঠল গাড়িতে। 

লাইব্রেরির সামনে নামাতে গিয়ে বান্ধবী বলল " বাড়ী না ঢুকে এখানে ? কি দরকার ? কাল সকালে আসিস। কি সব হচ্ছে শুনিশনি ? রিস্ক নিচ্ছিস কেন ?"   মেঘলা ছোট করে  বোঝালো ব্যাপার টা। গম্ভীর মুখ করে বান্ধবী বলল "আমিও থাকছি তোর সাথে, তোর কাজ মিটলে আমি যাবো, আমার তো পাশেই বাড়ি, কোনো চাপ নেই, স্কুটিও আছে। চঃ ভিতরে ।"  মেঘলার কোনো কথাই শুনলনা বান্ধবী।
 দুই বন্ধু ভিতরে বসে দুটো পেপার খুলে বসলো। গুন গুন করে গল্প করছে আর হাসছে। পেপার টা নামেই খোলা, কেউ পড়ছেনা। একটু পরেই তমোঘ্ন এল। বলল  "দিদি ওপরে চল। আরে বান্ধবী দিদি ? তুমিও আছো ? হেল্প করতে পারবে আমাদের ? যদিও ব্যাপারটা জানো কিনা জানিনা !"   বান্ধবী মিষ্টি হেসে বলল " হ্যাঁ রে ভাই, সব জানি। কি করতে হবে বল ?"  তমোঘ্ন জানাল দরকার হলে বলবে। এই বলে উপরে অফিস ঘরে চলে গেল দিদিকে নিয়ে। গিয়ে এসিস্ট্যান্ট লাইব্রেরিয়ান কে বলল তাদের বক্তব্য। তারা প্রধান লাইব্রেরিয়ান কে খুঁজল। এসিস্ট্যান্ট জানালো তিনি বই পড়তে খুব ভালোবাসেন। তাই নির্দিষ্ট একটা ঘর বানিয়েছেন নিচের তলায়। ওখানে একা পড়েন। খুব উৎসাহী কেউ যদি বহুবার বলেন নিয়ে যেতে তবে তাকে একলা নিয়ে যান ওই ঘরে, উনি সাইলেন্ট রিডার। চলুন ডাকি ওনাকে, বেরোনোর সময় তমোঘ্নর চোখ আটকালো অফিস ঘরের ব্যাংকের ওপর রাখা কাদা মাখা কম্বল টায়। দিদিকে ইশারা করল এগিয়ে যেতে । ও টুপ করে কম্বল টা পাড়তেই ঝন ঝন করে কি সব পরে যাওয়ার ধাতব আওয়াজ হলো। এসিস্ট্যান্ট ও মেঘলা ঘুরে তাকালো। দেখলো কাদা মাখা একটা কম্বলের ভিতর রক্তমাখা ছুরি, চাকু, ভোজালি, তীরের মতই ছোট্ট কি অস্ত্র, ধনুক এসব রয়েছে। ভয়ে বুক হিম হয়ে গেল সবার।
এসিস্ট্যান্ট বললো সে জানেনা এগুলো কিকরে এল। 

এসব করতে করতে শব্দ শুনে উপরে এসে গেছেন লাইব্রেরিয়ান । তিনি আপাদমস্তক জ্বলে উঠলেন এসব দেখে। বললেন "আপনাদের কে অনুমতি দিয়েছে এখানে ঢোকার ?" মেঘলা ব্যাপার টা সামলানোর চেষ্টা করল। কিন্তু উনি শুনতে নারাজ । তমোঘ্নকে বললেন " আপনি আর ম্যাডাম আপনি বাড়ি যান। এসব কি করে বেড়াচ্ছেন ? আর নীচে যারা আছে তাদের চলে যেতে বলুন সিকদার বাবু, বন্ধ হবার সময় হয়ে এল।আমার একটা বই এখনো বাকি, পড়া হয়নি। শেষ করে আমি চলে যাবো। আপনারা আসুন"।  বলেই দ্রুত সব জিনিস কম্বলে মুড়ে নিয়ে নীচে চলে গেলেন। তমোঘ্ন কিছু বলতে যাচ্ছিল তার সুযোগ ই দিলোনা। 

পিছন পিছন নামলো দুই ভাই বোন। কিন্তু ওনাকে আর দেখতে পেলনা। বুঝল সাইলেন্ট রিডার রুমে ঢুকেছেন উনি। নীচে অবাক হয়ে দেখল বান্ধবীর স্কুটিও নেই বান্ধবীও নেই। এভাবে ওদের না জানিয়ে বান্ধবী চলে যাবে তা ওরা ভাবেও নি। যদিও সারা লাইব্রেরিতে আর কেউ নেই। তাও চারিদিকে তাকাতে গিয়ে মেঘলা দেখল বান্ধবীর স্কুটির চাবি টা পরে তারা যেখানে বসে ছিল তার নিচে। হাতে সেটা তুলে নিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তমোঘ্নর দিকে তাকিয়ে বান্ধবীর মোবাইলে ফোন করল মেঘলা। ওদের আরো চমকে দিয়ে ফোনটি বেজে উঠলো কাছেই কোথাও।কিন্তু দেখতে পেলনা। তমোঘ্ন কিন্তু সাইলেন্ট রিডার রুমের দিকেই তাকিয়ে আছে। মনে হলো আওয়াজ টাও ঐদিক থেকেই আসছে। হঠাৎ থেমে গেল আওয়াজ টা। busy বলছে। মানে কেটে দিলো ফোন টা। আবার করল মেঘলা, এবার সুইচ অফ বলছে। কোনো কিছু না ভেবে তমোঘ্ন ধাক্কা মারল সাইলেন্ট রিডার ঘরের দরজায়। বারবার। কিন্তু কোনো উত্তর পেলনা। 

ওপর থেকে ছুটে এলেন এসিস্ট্যান্ট। থামানোর চেষ্টা করেন তমোঘ্নকে। কিন্তু মেঘলা বাধা দেয়। তমোঘ্ন মেঘলাকে বলে তার ফোন থেকে বাপি কে ফোন করে এখানে আসতে বলতে। এই কথা বলতে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে তমোঘ্ন , আর ঘরের দরজা খুলে কেউ ভিতরে সজোরে টেনে নেয় তাকে। তারপর দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দেয়। মেঘলা আঁতকে ওঠে এটা দেখে ,যে হাতটা দরজা খুলে তার ভাই কে ভিতরে টানল, সেটা রক্তে মাখা।  সেও মুহুর্মুহু ধাক্কা দিল দরজায় ভিতর থেকে শুনল ভাই এর গলা, "দিদি বাপীদের ডাক, ওরা সব জানে। আমাকে বাঁচা দিদিইই.…"  

ব্যাস, আবার সব চুপ চাপ। মেঘলা ফোন করল জয়জিৎবাবুকে । তারা আসেপাশেই ছিল, 2 জন কনস্টেবল, ইন্সপেক্টর মিত্র ও জয়জিৎবাবু ঢুকলেন। মেঘলা তখনও দরজায় ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে, ভাইকে ডেকে যাচ্ছে। সবাই মিলে জোরে ধাক্কা মারলো সাইলেন্ট রিডারের ঘরের দরজায়। হুড়মুড় করে ভেঙে গেল দরজা। ভিতরের দৃশ্য দেখে স্থির হয়ে গেল সবাই...  

লাইব্রেরিয়ান বসে আছে বান্ধবীর দেহের উপর।বসে আয়েশ করে খাচ্ছে তার হৃৎপিণ্ড টা। বুকের বাকি মাংস খুবলে খুবলে নেওয়া হয়েছে। পাঁজরের হাড় দেখা যাচ্ছে। ঘর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। পাশেই রক্ত মাখা ছুরিটা পড়ে আছে। তমোঘ্নর বুকেও গভীর ক্ষত। তবে তার হৃৎপিণ্ড এখনো খুবলে খায়নি । সবচেয়ে অবাক হল সবাই যখন দেখল লাইব্রেরিয়ান এর ছোট্ট ছেলে একটা সরাতে করে কয়লা জ্বালিয়ে, বান্ধবীর হাতের কাটা আঙ্গুলগুলো ওতে পুড়িয়ে কচর মচর করে খাচ্ছে। ওই আগুনের ওপর বান্ধবীর বুকের খুবলে নেয়া মাংসও পোড়ানো হচ্ছে। বাচ্চা ছেলেটা উলংগ, আর লাইব্রেরিয়ান এর গায়ে সেই কালো কম্বল টা জড়ানো।

 ওদের হঠাৎ আগমনে পাশে থাকা ছুরি টা তুলে নিয়ে ইন্সপেক্টর মিত্রের দিকে ছুঁড়লো লাইব্রেরিয়ান। মাথাটা ডানদিকে হেলিয়ে আঘাত থেকে বাঁচলেন তিনি। হঠাৎ জয়জিৎবাবু চিৎকার করে উঠলেন "খুকুউ…" অতর্কিত আক্রমনের জন্য প্রস্তুত ছিলনা মেঘলা । পিছন থেকে কেউ ওর মাথার আঘাত করল, তবে বাপি সাবধান করার জন্য একটু নিচু হয়ে গিয়েছিল বলে খুব জোরে লাগেনি। অল্প লেগেছে। অবাক হয়ে দেখল এসিস্ট্যান্ট হাতে একটা টেবিলের ভাঙ্গা পায়া নিয়ে আবার মারতে উদ্যত হচ্ছে। ওদিকে ঘরের ভিতর থেকে লাইব্রেরিয়ান ও ভোজালি টা উঁচিয়ে তেড়ে এল তাদের দিকে। মিত্রবাবু পিস্তল নিয়ে লাইব্রেরিয়ানএর হাত ও এসিস্ট্যান্ট এর পা লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লেন। দুজনেই আহত হয়ে পরে গেলেন। কনস্টেবল দুজন দৌড়ে গিয়ে দুজনকে পিছমোড়া করে ধরে পিঠের উপর চেপে বসল। মেঘলা ছুটে গেল তার ভাই এর রক্তাক্ত দেহের কাছে। " ভাই , ভাই , ভাই ওঠ, তুই সব ঠিক বুঝেছিলিস ,ভাই" বলে চিৎকার করে তমোঘ্নর শরীর তা ঝাঁকাতে লাগল। পাশে পড়ে থাকা বান্ধবীর দেহ টার দিকে তাকিয়েও ডুকরে কেঁদে উঠল সে। 

হঠাৎ কাঁধে একটা তীব্র যন্ত্রনা অনুভব করল সে। পিছন ফিরে দেখল ছোট্ট ছেলেটা তার কাঁধে কামড়ে দাঁত বসিয়ে দিয়েছে, রক্ত বেরোচ্ছে, জয়জিৎবাবু একঝটকায় ছেলেটিকে ছাড়িয়ে নিলেন। কাঁধ চেপে ধরে তমোঘ্নর শরীরের ওপর পরে গেল মেঘলা। ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল তমোঘ্নর দেহ। ভাই বলে চিৎকার করে উঠল মেঘলা। আবার ঝাঁকুনি দিল তমোঘ্নর দেহ। সঙ্গে সঙ্গে মিত্র বাবু তমোঘ্নর বুকের ওপর তিন চার বার প্রেস করলেন দুহাত দিয়ে। তারপর মুখে মুখে লাগিয়ে কৃত্রিম নিঃশ্বাস চালু করার চেষ্টা করলেন। দু তিনবার এই ভাবে চেষ্টা করতেই জোরে শ্বাস নিল তমোঘ্ন। মেঘলার ওড়না টা দিয়ে তমোঘ্নর বুক টা শক্ত করে বেঁধে দিলেন মিত্রবাবু। তমোঘ্ন চোখ খুলে তাকালো। জয়জিৎবাবুর হাতে তখন ছটফট করছে বাচ্ছা ছেলেটা। 
মেঘলার ফোনে বিভোর ফোন করল হঠাৎ। মেঘলাকে বলল "তোমরা 3জনের কেউ বাড়িতে নেই, মা তো জানেন ও না যে তুমি এসেছ। কোথায় তোমরা ?"  মেঘলা বিভোর কে বলে গাড়ি করে মা কে নিয়ে তাড়াতাড়ি লাইব্রেরি আসতে।
মিত্রবাবুও থানায় জানিয়ে দিলেন আরও ফোর্স ও গাড়ি আনার জন্য, বডি আছে একটা, আর আড়াইজন আসামি। 

বিভোর আর কথা দেবী এইসব দেখে ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। তিনি গতকাল তমোঘ্নর কথা মোটেও বিশ্বাস করেননি। ভেবেছিলেন দেরি হয়েছে বলে তার ছেলে গল্প বানাচ্ছে। তাই কোনো উৎসাহ ও দেখাননি। সকলে ধরাধরি করে তমোঘ্নকে গাড়ির ব্যাকসিটে শুইয়ে দিল। মাথাটা থাকল কথা দেবীর কোলে। গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে পাশে বসা মেঘলার কাঁধে রক্ত দেখে বিভোর জিগ্যেস করল "তোমার কাঁধে রক্ত কেন ? কি হয়েছে ?"  সব কথা বললো মেঘলা। তারপর বান্ধবীর বাড়িতে একটা ফোন করে ওর মা বাবা কে লাইব্রেরি তে যেতে বললো। ওনারা তো অবাক। কিছুই জানেননা। মেঘলাও খুব কষ্টে চুপ করে থাকলো। কিছুই জানাতে পারলনা।  

  বেশ কয়েকদিন পর সুস্থ হল তমোঘ্ন আর মেঘলা। সেদিন বান্ধবীর পারলৌকিক কাজ। সবাই বান্ধবীর বাড়িতে তার মা বাবার সাথে দেখা করতে আসে। সেখানে মিত্রবাবুও ছিলেন। ততদিনে জেলে লাইব্রেরিয়ান তার এসিস্ট্যান্ট ও ছেলে সমেত। বউ এর দেহাংশ ও উদ্ধার হয় গঙ্গার পাড় থেকে।  তমোঘ্নকে মিত্রবাবু বলেন "এবার বলো, তুমি ঠিক কি কি দেখেছিলে আর কি বুঝতে পেরেছিলে ?"  পুরোটা কেউ ই জানতনা। 

প্রথম থেকে শুরু করে সে, " যখন বিমল দাদুর আধ খাওয়া দেহটা দেখতে যাই , আমাদের বাড়ির ভাড়াটিয়া বিল্টুর থেকে জানতে পারি ঘটনা টা কি, আমার মনে সন্দেহ আগের রাতেই হয় । কিন্তু বিশ্বাস করতে পারিনি বইতে বা গুগলে পড়া cannibalism সত্যিই হতে পারে। সারারাত নেট ঘেঁটে উদ্ধার করি পুরুলিয়া ও ঝড়খণ্ডে কিছু আদিবাসী বেশ কয়েকবছর আগেও নরমাংস খেয়েছে। ওদের মধ্যে চলে এগুলো। তারপর লাস্ট ওদের দেখা যায় 2015 তে। এরপর এরকম কোন ঘটনা জানা যায়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে এখন ওদের বংশধররা পড়াশোনা করে শিক্ষিত হচ্ছে, তাই এই সামাজিক অবক্ষয় দূর হয়েছে। কিন্তু গত বছর হাওড়ার বালি অঞ্চলে কয়েকটা এরকম ঘটনা ঘটে। সেখানকার পর আর কোনও খবর নেই। আমি বিল্টুর থেকে জানতে পারি এই লাইব্রেরিয়ান ও বালি তে ছিলেন এখানে আসার আগে। আমার ওনাকে সন্দেহ হতে থাকে। মায়ের থেকে জানতে পারি এনারাও আদিবাসী, ভাষা বোঝা নাকি অসম্ভব। আবার আগের বউটা কিকরে মরেছে সত্যি কেউ জানেনা। এরাও সারাদিন ঘরে দরজা বন্ধ করে থাকে। বউটা কেমন ঝিমোয়। 

আমি লক্ষ্য রাখতে শুরু করলাম। দেখলাম একটা বড় ব্যাগ নিয়ে সাইকেলে করে বেরোলেন। একটু পরেই ওনার বউ জল আনতে গেল বিল্টুর মায়ের সাথে ঘরে তালা দিয়ে। সন্দেহ হল ওই টুকু বাচ্চাকে ঘরে তালা দিয়ে কেউ রাখবেনা। আমি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম। সাইকেল টা স্পিড এ চালিয়ে দেখি লাইব্রেরিয়ান লাইব্রেরিতে ঢুকছেন। আমি পিছনের দিকের ক্লাবটার ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম । আমাকে লাইব্রেরিয়ান এতটা চিনত না।ফলে কোনো সন্দেহ করলনা। আমি দেখলাম উনি বড় ব্যাগ টা খুব ধীরে সাইকেল থেকে নামালেন। তারপর এদিক ওদিক দেখে ব্যাগ থেকে আস্তে করে বের করলেন ছেলেকে। দেখে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ। বেশ বুঝলাম কাল রাতে সাঁকোর নীচে এরাই ছিল কম্বল মুড়ে। তারপর আরেকটি ব্যাগে থাকা কম্বল ও অস্ত্র গুলো মুড়িয়ে নিয়ে ঢুকে গেল। আমি বাপিকে বাড়ি ফিরে সব বললাম। মা তখন বিমল দাদুর বাড়ি। বাবা আর আমি থানায় গিয়ে সব বললাম। ইন্সপেক্টর মিত্র আমার কথায় বিশ্বাস করে এত বড় রিস্ক নিয়েছেন। আমি আপ্লুত।"  
বান্ধবীর  বাবা চোখের জল মুছে মেঘলাকে বললেন"আমাদের মেয়েটার কি হয়েছিল রে মেঘলা মা ?" মেঘলা বলার আগেই তমোঘ্ন পুরোটা বলল। শেষে বলল " আমাকে যখন দরজা খুলে আচমকাই টেনে ঢোকায় ভিতরে তখনও বান্ধবী দিদি বেঁচে ছিল। গলা টা ছুরি দিয়ে কেটে দিয়েছিল বলে কথা বলতে পারেনি কিন্তু আমাকে দেখে হাত টা তুললো, সাথে সাথে লোক টা বান্ধবী দিদির হাতের আঙ্গুল গুলো কেটে নিয়ে আগুনে ফেলে দিল।  তারপর বান্ধবী দিদির বুক থেকে ছুরি দিয়ে এক খাবলা মাংস তুলে নেয়। বান্ধবী দিদি তখন অসার হয়ে যায়।আগুনে আগে থেকেই অন্য মাংস ছিল।মনে হয় ওনার স্ত্রীর । দুপুরে একা বাড়ি ফিরছিলেন। বেরোন যখন আবার বড় ব্যাগ নিয়ে। লাইব্রেরি তে এসেই সাইলেন্ট রিডার রুমে ঢুকে যান। সম্ভবতঃ ওই ব্যাগেই স্ত্রীর মাংস ছিল। ছেলেকে খাওয়ানোর জন্য এনেছিলেন। এইভাবেই হয়ত আগের স্ত্রী কেও মেরেছিলেন। আমরা গিয়ে গোলমাল করছিলাম বলে আমাদের সরানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বান্ধবী দিদি যে উনি উপরে আসার সময় সাইলেন্ট রিডার রুমে ঢুকে সব দেখে ফেলবে তা উনি ভাবেননি। উনি নেমে এসে দেখেন বান্ধবী দিদি ওই ঘরের সামনে। উনি দিদিকে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন। ওনার সাহায্যকারী হল এসিস্ট্যান্ট ও বিল্টু। তবে দুজনকেই ভয় দেখানো হয়েছিল যদি সাহায্য না করে তবে তাদের পরিবারের মানুষ গুলো কে খেয়ে ফেলবেন। বিল্টুকে আমি বান্ধবী দিদির গাড়ি নিয়ে পালাতে দেখেছিলাম। আমার দিদি এসিস্ট্যান্ট এর সাথে কথা বলছিল। আমি পিছনে ছিলাম, তখন ই দেখেছি। ও বেপাত্তা। নিশ্চয়ই মিত্রবাবু খুঁজে বার করবেন। আর আমাকে একবার ছুরি মারতেই আমি অজ্ঞান হয়ে যাই তাই ও আর আমাকে মারতে আসেনি।"  মিত্র বাবু বলেন " আগের একটা স্ত্রী না,  3টে স্ত্রী কেই উনি এইভাবে মেরে খেয়ে নিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জেনেছি। আর এই ছেলে ওনার দ্বিতীয় স্ত্রীর। ছেলের দুবছর বয়সেই উনি লক্ষ্য করেন ছেলেও তার মতো । কাঁচা মাছ, মাংস বাজার থেকে আনলে খেয়ে ফেলত। তাই উনি একদিন স্ত্রী কেই মেরে দুজনে মিলে খেয়ে ফেলেন । কিন্তু ছোট ছেলে এত শক্ত মাংস খেতে পারবেনা তাই তাকে পুড়িয়ে মাংস খাওয়ান তিনি।"

   এসব শুনে বিভোর বলল "যাও বা এতদিন মেঘলা ওই কবরখানার পাস দিয়ে যেত, আর মনে হয় যাবেনা।" শুনে সবাই হেসে উঠল। 

কিন্তু বান্ধবীর মা বাবার ম্লান মুখের দিকে তাকিয়ে মেঘলা বলল " যার বান্ধবী আছে, তার আবার ভয় কি ? আমাকে সেদিন বান্ধবী ই  নিয়ে গিয়েছিল। নাহলে হয়ত ভয়টাই রয়ে যেত আমার। ও মজা করেছিল বলে রাগ ও হয়েছিল। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি ওর মতো সাহসী যদি হতাম তাহলে আর সেদিন ওকে আমার জন্য অকালে চলে যেতে হতনা। আমি ভীতু বলেই ও সাহায্য করতে এসেছিল। ওর মতো ডাকাবুকো হলে তো আর ওকে যেতে হতনা। তাই আমি আর কোনো ভয় করবনা। আমার বান্ধবী আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে ভয় কত মারাত্মক রোগ ! "  

বান্ধবীর স্কুটির চাবিটা ব্যাগ থেকে বের করে মুঠোয় শক্ত করে ধরল মেঘলা।
রচনাকাল : ৮/৬/২০২০
© কিশলয় এবং অস্মিতা ভাদুরী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 29  China : 6  Europe : 1  France : 4  Germany : 2  Hungary : 1  India : 169  Ireland : 9  Russian Federat : 10  Saudi Arabia : 6  
Sweden : 12  Ukraine : 8  United States : 297  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 29  China : 6  Europe : 1  France : 4  
Germany : 2  Hungary : 1  India : 169  Ireland : 9  
Russian Federat : 10  Saudi Arabia : 6  Sweden : 12  Ukraine : 8  
United States : 297  
লেখিকা পরিচিতি -
                          ১৯৯১ সালের ১১ই জানুয়ারি হাওড়া জেলার অখ্যাত গ্রাম হিরাপুরে জন্মগ্রহণ করেন অস্মিতা। বর্তমানে কোন্নগরবাসী এই লেখিকার, ছোট থেকেই লেখা লিখির প্রতি ঝোঁক ছিল। মূলত মা কে দেখেই অনুপ্রেরণা পান লেখিকা। পেশায় শিক্ষিকা হলেও শখ বলতে নিজের ছোট্ট বাগানের ও পোষ্যদের পরিচর্যার পাশাপাশি গান শুনতে ভীষন ভালোবাসেন। বেড়ানো, ছবিতোলা, নাচের কোরিওগ্রাফ করা শখের মধ্যেই পড়ে। কলম যেহেতু তলোয়ারের চেয়েও  শক্তিশালী, তাই নিজের বলতে না পারা সব কিছুর প্রতিবাদ লেখা দিয়েই করেন। 

ভালো থাকায় ও ভালো রাখায় বিশ্বাসী হয়ে, পরিচিত অক্ষর ও শব্দ দিয়েই , নতুন গল্পমালার সৃষ্টি করেন ! 
                          
© কিশলয় এবং অস্মিতা ভাদুরী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সাইলেন্ট রিডার by Asmita Bhadury is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫৪০৮০০
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী