মলয়বাবু রোজকার মতই সেদিনও প্রাতঃভ্রমনে বেরিয়েছেন । ভোরের আলো তখন সদ্য ফুটেছে । নীড় ছেড়ে পক্ষীকুল তখন কিচিরমিচির শব্দ করে এদিক ওদিক উড়ে বেড়াচ্ছে । কয়েকজন লোক ছাড়া পথ ঘাট প্রায় শুনশান । মলয়বাবু আপন মনে হেঁটে চলেছেন । কিছুদূর যেতেই ফাঁকা একটি মাঠের প্রান্তে অস্পষ্ট কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলেন । তিনি দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়ে দেখলেন ঝোপের আড়ালে একটি সদ্যোজাত শিশু তোয়ালে মোড়া অবস্থায় পড়ে রয়েছে । মলয়বাবু হতবাক ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে শিশুটির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন । হঠাৎ দেবদূতের মত এক মহিলার উদয় হল । পরনে মলিন বেশ, জীর্ণশীর্ণ চেহারা, এলোমেলো কেশ । চোখ দুটো যেন ক্ষুধার জ্বালায় কাতর । সে এদিক ওদিক তাকিয়ে মলয়বাবুকে কিছু না বলে নীরবে শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে তার ছিন্ন আঁচলে লুকিয়ে দ্রুতপদে চলতে লাগল । মলয়বাবুও কৌতুহলবশত তাকে অনুসরণ করতে লাগলেন । ভিখারিনী মহিলাটি যেতে যেতে এক জায়গায় এসে থামলো । সেটা একটা স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম । সেখানেই এককোনে ভিখারিনীর আস্তানা । শিশুটিকে তার সেই মলিন ছিন্ন বিছানায় শুইয়ে দিয়ে পাহারা দিতে থাকল । কিছুক্ষণ পরে প্ল্যাটফর্মের চায়ের দোকান খুলতেই সেখান থেকে একটু দুধ চেয়ে নিয়ে বাচ্চাটিকে খাওয়ালো । বেলা বাড়ার সাথেসাথে সে শিশুটিকে বুকে নিয়ে ভিক্ষের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল । এতদিন যারা তাকে দূর দূর করে তাড়াত তারাও সেদিন শিশুটিকে দেখে দয়া করে কিছু দান করল । সেই থেকে ভিখারিনী মায়ের নতুন জীবনের পথ চলার শুরু । মা তার আদরের শিশুকন্যার নাম রাখল দুলালী ।
ক্রমে ক্রমে তারা স্টেশনের নিত্যযাত্রী থেকে শুরু করে প্ল্যাটফর্মের দোকানদার সকলের পরিচিত মুখ । সকলেই তার মাতৃত্ব , স্নেহ মায়া দেখে পরম বিস্মিত । কিছু সহৃদয় ব্যক্তির সাহায্যে ভিখারিনী তার শিশুটিকে বাঁচিয়ে তুলল । মলয়বাবুও মাঝে মাঝে এসে কিছু সাহায্য দিয়ে যেতেন । এভাবেই দিন,মাস বছর গড়িয়ে প্রায় পাঁচ বছর কেটে গেল । মলয়বাবু মাঝে বেশ কিছুদিন শারিরীক অসুস্থতার জন্য তাদের খোঁজ পাননি।সুস্থ হবার পর একদিন তিনি বেশকিছু খাবার দাবার খেলনা,বস্ত্র নিয়ে সেই ভিখারিনী মায়ের আস্তানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন । কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর কিছু আগেই দেখতে পেলেন কিছু লোকের ভিড় আর শোনা যাচ্ছে একটি শিশুর কান্নার আওয়াজ । মলয়বাবুর বুকটা যেন অজানা আতঙ্কে শিউরে উঠল । তাঁর পা দুটো যেন ভারী বোধ হল । সেখানে গিয়ে ভিড় সরিয়ে যা দেখতে পেলেন তাতে তাঁর সমস্ত শরীরটা যেন অবশ হয়ে গেল । হাত থেকে দানসামগ্ৰীর প্যাকেটটা মাটিতে পড়ে গেল । ভিখারিনী শুয়ে রয়েছে আর তার নিথর দেহের বুকের উপর শুয়ে শিশুটি কেঁদে চলেছে । মলয়বাবু কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলেন ।শিশুটি দ্বিতীয়বার আবার অনাথ হলো । মলয়বাবু সাত পাঁচ না ভেবে একটি পরিচিত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন । তারা এসে শিশুটিকে নিয়ে চলে গেল । মাতৃহারা শিশুটির কান্নার আওয়াজ আকাশে বাতাসে মিশে ধীরে ধীরে ক্ষীণ হতে লাগলো । কয়েকদিন পর মলয়বাবু খবর পেলেন শিশুটি একটি অনাথ আশ্রমে রয়েছে । এভাবে কয়েক বছর কেটে গেল । দুলালী তখন সাবালিকা । লেখাপড়া শিখছে, হাতের কাজেও সে পটু । মলয়বাবু একদিন ঠিকানা নিয়ে সেই অনাথ আশ্রমে গিয়ে দুলালীর সাথে দেখা করলেন এবং তার পালিতা মায়ের করুণ কাহিনী শোনালেন । দুলালী আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবতে ভাবতে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে নীরবে চলে গেল ।হয়তো তার মায়ের মুখটা এখন অস্পষ্ট হয়ে গেছে । ছোটবেলার স্মতিগুলো হয়তো আবছা হয়ে গেছে । মলয়বাবু ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আশ্রম থেকে বাড়ীর দিকে রওনা দিলেন।
রচনাকাল : ৮/৬/২০২০
© কিশলয় এবং যুথিকা দেবনাথ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।