ভন্ড
আনুমানিক পঠন সময় : ৬ মিনিট

লেখক : শুভেন্দু ভৌমিক
দেশ : India , শহর : Kolkata

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , জুন
প্রকাশিত ১০ টি লেখনী ২৬ টি দেশ ব্যাপী ৪৮৭০ জন পড়েছেন।
- ব্যোম ভোলে..হর হর মহাদেব!

চায়ের দোকানে বেঞ্চিতে বসে চা খেতে খেতে সবে বিড়িতে একটা সুখটান দিয়েছিলাম, আচমকা পিছন দিক থেকে কান ফাটানো আওয়াজটা আসলো।

- ব্যোম ভোলে..হর হর মহাদেব!
আমি পিছন ঘুরে দেখি একটু দূরেই এক সাধুবাবা বসে আছেন আর জোরে জোরে বাবা মহাদেবের নাম করছেন। আমি সেদিকে দেখতেই সাধুবাবা আমার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসলেন। তারপর ইশারায় আমাকে তাঁর কাছে ডাকলেন।

সত্যি কথা বলতে এসব ভন্ড সাধুবাবা-টাবাদের উপর আমার একদম বিশ্বাস হয় না। তাও ডাকলো যখন, তখন একবার গিয়ে দেখি কী বলেন।

- আমাকে ডাকলেন নাকি বাবা?
- হ্যাঁ রে ব্যাটা..বোস বোস।

তিনি এক দৃষ্টিতে আমার কপালের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলেন। তারপর মুচকি হেসে আবার জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন- ব্যোম ভোলে..হর হর মহাদেব। আরে ব্যাটা, তোর তো ভাগ্য খুলে যাবে আর ক'দিনের মধ্যেই। যাহ্ ব্যাটা..মহাদেবের নামে এখানে কিছু দান করে নিশ্চিন্তে বাড়ি যা।
আমি সাধুবাবার কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলাম।

- বাবা, এসব গুলবাজি কথায় আমাকে ভুলিয়ে মহাদেবের নামে পয়সা আদায়ের ধান্দা করছেন দেখছি। শুনে রাখুন, আপনাদের মত ভন্ডর এইসব ভন্ডামিতে আমি ভুলবো না। আমি চললুম।
- আমাকে কিছু দিবি না তাতে কিছু যাবে আসবে না রে ব্যাটা। কিন্তু এটা জেনে রাখ আজ থেকে কিছুদিনের মধ্যেই তোর জীবনে বড়-সড় পরিবর্তন আসতে চলেছে। মিলিয়ে নিস আমার কথা।

সাধুবাবার ওখান থেকে বিদায় নিয়ে চা-এর দোকানের পয়সা মিটিয়ে নিজের বাড়ির পথে রওনা দিলুম।

- বাবু বাবু..কিছু কাজ হবে। গত পাঁচদিন ধরে কিছু খাইনি বাবু।
ডাক শুনে পিছন ঘুরে দেখি একটা ২৬-২৭ বছরের ছেলে, একটা বহুদিনের পুরোনো ময়লা ছেঁড়া-ফাটা জামা-প্যান্ট পরা। আমি ছেলেটার দিকে একটা কুড়ি টাকার নোট বাড়িয়ে দিয়ে বললাম- আমার কাছে করার মত কোনো কাজ-টাজ তো কিছু নেই রে। এটা দিয়ে কিছু খেয়ে নিস বরং।
- আমার এমনি এমনি পয়সা লাগবে না বাবু, আমি ভিখারী নই। আপনি যদি কিছু কাজ দেন, আর তার পরিবর্তে পয়সা দেন, তাহলে আমি নিতে পারি।
ছেলেটার কথাগুলো শুনে ভারী ভালো লাগলো। গত পাঁচদিন ধরে কিছু না খেলেও তার আত্মসম্মানবোধটা আছে।
- ঠিক আছে, আমার সঙ্গে চল্। আমি একাই থাকি। ঘর-দোর সামলানো আর রান্নার কাজে সাহায্য করে দিবি, তার পরিবর্তে দু'বেলা খেতে পাবি।
- আজ্ঞে ঠিক আছে বাবু।

ছেলেটার নাম ভোলা। ভোলাকে নিয়ে আসায় আমার বেশ উপকারই হয়েছে। ঘরের সমস্ত কাজেই ভোলা সাহায্য করে আমাকে। এক এক সময় তো জোর করে আমাকে কোনো কাজ করতে দেয় না। তবে আমার নিজের পার্সোনাল বেডরুমটায় আমি কাউকে ঢুকতে দিই না। সেটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, অ্যাটাচড্ বাথরুমটা পরিষ্কার করা এগুলো সব আমি নিজের হাতেই করি। দু-একবার বলেছিল আমাকে যে এই কাজগুলোও ও করে দেবে। কিন্তু কেন জানিনা ঠিক ভরসা করতে পারিনি। তবে আমার ঘরের বিছানা ঝাড়া বা বাথরুমটা পরিষ্কারের সময় ভোলা বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে দেখে যে আমি কত যত্নসহকারে নিজের ঘর-বাথরুম পরিষ্কার করছি। আমাকে এসব করতে দেখে মাঝে মাঝে ওর মুখে মুচকি হাসি ফুটে ওঠে।

ক'দিন ধরেই দেখছি চায়ের দোকানের সামনে দেখা হওয়া সেই সাধুবাবা আমার বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। মাঝে মধ্যে দেখি ভোলাও সাধুবাবার কাছে যায়। আমি ভোলাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করাতে সে বলল যে সে নাকি তার ভাগ্যের ব্যাপারে জানতে যায়। সাধুবাবা তাকে বলেছে যে আর কিছুদিনের মধ্যেই তার ভাগ্য খুলবে। শুনে আমার মনে মনে খুব হাসি পেল। সহজ-সরল সাধারণ মানুষদের কী সুন্দরভাবে ঠকায় এই ভন্ডগুলো।

সেদিন হঠাৎ বাজার থেকে ফিরে এসে দেখি ঘরের মধ্যে ভোলা আর সেই সাধুবাবা দুজনে ফিস-ফিস করে কীসব কথাবার্তা বলছে। আমাকে দেখতে পেয়েই সাধুবাবা চেঁচিয়ে উঠলেন- ব্যোম ভোলে..হর হর মহাদেব!
এসব দেখে মাথাটা গরম হয়ে গেল। রেগে গিয়ে ভোলাকে বললাম- তুই এই ভন্ড সাধুবাবাকে এখানে নিয়ে এসেছিস কী করতে? তোকে বলেছিলাম না, আমার ঘরে কাউকে কোনদিন ঢুকতে দিবি না। কোন সাহসে করেছিস এসব?

আমার কথা শুনে ভোলা হো-হো করে হেসে উঠলো। তারপর দেখি সাধুবাবা ঝোলা থেকে একটা রিভলভার বের করে আমার দিকে তাক করে বললেন- হ্যান্ডস্ আপ্ মিস্টার বর্মন। অনেকদিন ধরে আপনার পিছু-পিছু ঘুরে এবার আপনাকে বাগে পেয়েছি।
- একি কী হচ্ছে এসব? কে আপনারা? আমাকে এভাবে ভয় দেখাচ্ছেন কেন? আমি পুলিশ ডাকবো কিন্তু বলে দিলুম।
- সে কষ্ট আপনাকে করতে হবে না মিস্টার বর্মন। অলরেডি আপনার বাড়ির চারপাশ পুলিশ ঘিরে নিয়েছে। আপনার পালাবার কোনো পথ নেই।
এই কথা বলে সাধুবাবা এক এক করে তাঁর চুল-দাড়ি-গোঁফ সব খুলে একটা টেবিলের উপর রাখলেন। দেখি সামনে সাধুবাবার পরিবর্তে এক সুদর্শন যুবক দাঁড়িয়ে আছে।

- ব্যোম ভোলে..হর হর মহাদেব! ওহ্ সরি সরি, আপনাকে আমার পরিচয়টা দেওয়া হয়নি মিস্টার বর্মন। আমি সিবিআই অফিসার হরজিত সরকার।
- আর আমি ভোলানাথ বিশ্বাস। ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের অফিসার।
পাশ থেকে ভোলা বলে উঠলো।
- বহুদিন ধরে আমাদের কাছে আপনার ব্যাপারে খবর ছিল মিস্টার বর্মন। কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে কোনোরকম প্রমান জোগাড় করতে পারছিলাম না। অবশেষে হরজিতদার সাহায্য নিয়ে এই খেলাটা খেলতে হয় আমাদের।
- কিন্তু আপনারা আমার এখানে কী করছেন। আমি একজন যতসামান্য চাকুরীজীবী মানুষ। আমার বাড়িতে ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের লোকের কী কাজ?
- সব বলছি। আপনার বেডরুমে চলুন। ভোলা, বাইরে থেকে আরো দুজনকে ডেকে নিয়ে আসো তো। ওদেরকে ছুরি আর শাবলটাও নিয়ে আসতে বোলো।

আমি তখন আমার বেডরুমের বাইরে চুপচাপ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছি। ওঁরা আমার বেডরুমে ঢুকে প্রথমেই আমার বিছানার চাদর-টাদর সব তুলে ফেললেন। তারপর একজন ধারালো ছুরি দিয়ে গদির চারপাশটা কেটে ফেলতেই দেখা গেল গদির ভিতরটা পুরো গাদা-গাদা টাকার বান্ডিলে ঠাসা।
- এগুলো কী যতসামান্য চাকুরীজীবী মানুষের রোজগার মিস্টার বর্মন?
তারপর তাঁরা আমার বেডরুমের অ্যাটাচড্ বাথরুমটাতে গিয়ে ঢুকলেন। তারপর শাবল দিয়ে বাথরুমের দেওয়ালগুলোতে বারি মারতে লাগলেন। টাইলস্ গুলো ভেঙে গিয়ে তার ভিতর থেকে থোক-থোক টাকার বান্ডিল বেরিয়ে আসলো।

প্রায় ঘন্টা তিনেক পর..
- হরজিত দা, সব মিলিয়ে বত্রিশ লক্ষ কোটি টাকা।

- মিস্টার বর্মন, আপনি একটি আস্ত ঘাগু মাল। বিভিন্ন প্রোমোটারদের বেআইনি পথে প্ল্যান স্যাঙ্কশন করিয়ে দিয়ে তাঁদের থেকে মোটা মাল আদায় করেছেন আপনার এই এত বছরের চাকরী জীবনে। কিন্তু কোথাও কোনো প্রমান রাখেননি। আগে যে যে ইনকাম ট্যাক্স অফিসার ছিলেন তাদের সবাইকেও আপনি ঘোল খাইয়ে ছেড়েছেন। যাকে বলে একদম ফ্ল-লেস কাজ। এতগুলো টাকা থেকেও আপনি অত্যন্ত সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। যার ফলে আপনাকে ধরা আরো কঠিন হয়ে গেছিলো। কিন্তু রিটায়ারমেন্টের মাত্র এক বছর আগে ভোলার বুদ্ধির কাছে হেরে গেলেন আপনি। দুঃখের বিষয় আপনার অসদুপায়ে জমানো এতগুলো টাকা আপনার ভোগে লাগলো না।

- হরজিত দা, আমার তো সেদিন থেকেই সন্দেহটা পাকাপোক্ত হলো যখন দেখলাম যে আমি থাকতেও উনি নিজের বিছানা আর অ্যাটাচড্ বাথরুম এই দুটো নিজেই পরিষ্কার করেন। তাও আবার অত্যন্ত যত্নসহকারে। বাথরুমের টাইলসে্ কখনো জল দিতেন না। সবথেকে বড় কথা উনি অ্যাটাচড্ বাথরুমটা নিজে ইউজ্ পর্যন্ত করতেন না। বাইরের বাথরুমটাই ইউজ্ করতেন।

- কী মিস্টার বর্মন..আমি আপনার কপাল দেখে বলেছিলাম তো কিছুদিনের মধ্যেই আপনার জীবনে বড়-সড় পরিবর্তন আসতে চলেছে। মিললো তো এই "ভন্ড"-র কথা।

                                    (সমাপ্ত)

কলমে - শুভেন্দু ভৌমিক ©®
রচনাকাল : ৭/৬/২০২০
© কিশলয় এবং শুভেন্দু ভৌমিক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 1  Canada : 31  China : 8  Europe : 1  France : 7  Germany : 1  India : 179  Ireland : 19  Japan : 1  Norway : 1  
Russian Federat : 7  Sweden : 12  Ukraine : 6  United States : 167  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 1  Canada : 31  China : 8  Europe : 1  
France : 7  Germany : 1  India : 179  Ireland : 19  
Japan : 1  Norway : 1  Russian Federat : 7  Sweden : 12  
Ukraine : 6  United States : 167  
লেখক পরিচিতি -
                          শুভেন্দু ভৌমিক ৬ ই মার্চ কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন।

ছোটবেলা থেকেই তাঁর সাহিত্যের প্রতি দারুণ ঝোঁক। তিনি চাকরী করার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চা করতে ভালোবাসেন। ফেসবুকের বিভিন্ন সাহিত্যগ্ৰুপে অণুগল্প, ছোটগল্প লেখালিখি করেন।

অবসর সময়ে বিভিন্ন গল্পের বই পড়তে, সানডে সাসপেন্স শুনতে এবং টিভিতে ক্রিকেট-ফুটবল ম্যাচ দেখতে ভালোবাসেন। 
                          
© কিশলয় এবং শুভেন্দু ভৌমিক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
ভন্ড by Subhendu Bhowmick is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫৪০৮৫২
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী