স্থান গাঁয়ের পথের একাংশ। সময় মধ্যরাত্রি মঞ্চের এককোণে একফালি আলোক রেখা। আলো আঁধারী পথে রাস্তার কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। চকিতে নেপথ্যে জন কোলাহল – “চোর চোর --- চোর এসেছে চোরকে ধরো “।
চকিতেই নেপথ্যে ভেসে আসে--
পুরুষ কণ্ঠস্বর: হ্যালো! ডায়মণ্ড হারবার পুলিশ স্টেশন। আমি কাঁকরডাঙা গাঁয়ের চৌধুরী পরিবার থেকে বলছি। এখানে একটা চোর এসে মাঝরাতে চুরি করে পালাচ্ছে। গাঁয়ের ছুটে বেরিয়ে এসেছে। চোর ধরা পড়বে নিশ্চয়ই। শীঘ্রই আসুন। স্যার, নইলে ………
মহিলা কণ্ঠস্বর: ডোন্ট ওয়্যারি। আমরা আসছি। ফোন কাট হয়ে যায়।
নেপথ্যে পুনরায় জন কোলাহল- ঐ ঐ চোর পালিয়ে যাচ্ছে। তাকে ধরো তাকে ধরো।
বস্তা কাঁধে মি. চোর প্রবেশ করে। পরণে সাদা হাফ সার্ট, সাদা পায়জামা। পায়ে চটিজুতা।
মঞ্চের আলো জ্বলে ওঠে।
মিঃ চোর: না না, আমি চোর নই, আমি চুরি করি নি। কে বলেছে আমি চোর, আমি যদি চোর হতাম তাহলে কি আমি গাঁয়ের লোকদের কাছে ধরা পড়তাম। ঐ ঐ ওরা ছুটে আসছে। আমি পালাই আমি পালিয়ে যাই। কিন্তু কোথায় পালাব। যেদিকে চাই চারদিকে ওরা সবাই ঘিরে ফেলেছে। কোনদিক দিয়ে পালাই…
(নেপথ্যে পুলিশের ভ্যানের শব্দ। পুলিশের ভ্যান থেকে কয়েকজন সেপাই সহ
নেমে আসেন মহিলা সাব ইন্সপেক্টর পুলিশ কমিশনার।
উদ্যত পিস্তলহস্তে মঞ্চে প্রবেশ করেন)
ইন্সপেক্টর: হ্যাণ্ডস্ আপ! হাত তোল তোল হাত। নো নো পালাবার চেষ্টা করবে না। সেপাই, ওর বস্তায় কি আছে বের করো।
(মিঃ চোর হাত তুলে দাঁড়ায়। একজন সেপাই বস্তা থেকে বের করে দুটি থালা, দুটি বাটি একটি গেলাস আর একটি ঘটি)
হাউ স্ট্রেঞ্জ। টাকা পয়সা কিছু নেই? কোন দামী অলংকার বা অন্য কিছু।
জনৈক সেপাই: এছাড়া আর কিছুই নেই স্যার।
ইন্সপেক্টর: অল রাইট। সেপাই, ওর হাতে লক-আপ পরিয়ে দাও।
মিঃ চোর: না না, আমায় আপনারা ছেড়ে দিন। আমি চোর নই, আমি চুরি করি নি, চুরি করেছে আমার বিবেক, আমার শিক্ষা, আমার শালীনতাবোধ। আমি আ – আমি---
ইন্সপেক্টর: গায়ে তোমার সাধারণ সাদা পোশাক। মনে হচ্ছে সহজ সরল সাধারণ মানুষ, ভদ্র সন্তান। শিক্ষিত?
মিঃ চোর: ইয়েস! অনার্স গ্রাজুয়েট, শুধু পয়সার অভাবে এম. এ পরীক্ষাটা দিতে পারি নি।
ইন্সপেক্টর: ও আই সি।
মিঃ চোর: জানেন ইন্সপেক্টর, আমার দুইচোখে ছিলো বড়ো হবার স্বপ্ন। লেখাপড়া শিখে মানুষ হওয়ার স্বপ্ন। কিন্ত আমার দুর্ভাগ্য।
ইন্সপেক্টর: আফশোষ, বহুত আফশোষ। তোমার জন্য আমার দুঃখ হয় মিঃ চোর ।
মিঃ চোর: দুঃখ হয়? ফিল করতে পারেন অভাবে মানুষের স্বভাব নষ্ট হয়।
ইন্সপেক্টর: কিছুটা পারি ।
মিঃ চোর: কিছুটা পারেন। সবটা পারেন না। অভাবে পড়ে শিক্ষিত ছেলেরা যদি চুরি করে আপনাদের উঁচুতলার সমাজ তাদের বলবে সমাজ বিরোধী।
ইন্সপেক্টর: হোয়াট, কি বলতে চাও তুমি?
মিঃ চোর: বলতে চাই, মানুষ সমাজ বিরোধী হয়েই জন্মায় না। পরিবারের অভাব, অনটন, আর পারিপার্শিক পরিবেশ তাকে সমাজবিরোধী করে তুলতে বাধ্য করে।
ইন্সপেক্টর: তোমার কথাগুলো হয়তো ঠিক মিঃ চোর। বাই দি বাই জানতে পারি তোমার নামটা কি?
মিঃ চোর: আমার কোন নাম নেই। আমি একটা নামহীন জ্বলন্ত উল্কা। অথচ একদিন কলেজের প্রিন্সিপ্যাল আমার গলায় সোনার মেডেল পরিয়ে বলেছিলেন – তোমরা জাতির ভবিষ্যত। আগামীদিনের পৃথিবী তোমাদের কাছ থেকে অনেক কিছুই আশা করে। স্বপ্ন সে সব বোধ হয় সবই স্বপ্ন। আজ আমার একমাত্র পরিচয় আমি একজন সমাজবিরোধী। (আবেগে বলে ওঠে) হ্যাঁ, হ্যাঁ , আমি চোর। আমি চুরি করবো, আমি ছিনতাই করবো। জন-জীবনকে আমি বিষিয়ে তুলবো।
ইন্সপেক্টর: কার সামনে দাঁড়িয়ে কথাটা বলছো মিঃ চোর। আমার মাত্র একটা গুলিতে তোমার বুকটা ঝাঁঝরা হয়ে যেতে পারে তা কি তুমি জানো?
মিঃ চোর: জানি ইন্সপেক্টর। কিন্তু উপোষ করে মরতে আমি রাজি নই। আমি চাই- হাউইয়ের মত দপ করে জ্বলে উঠে মূহুর্তে নিঃশেষ হয়ে যেতে। সুকান্তের দেশলাই-এর মতো অসতর্ক মূহুর্তে হঠাত্ জ্বলে উঠে সাবা বিশ্বকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে।
ইন্সপেক্টর: চ্যালেঞ্জ করো না মিঃ চোর, ফল ভালো হবে না।
মিঃ চোর: কি করবেন? গুলি?
ইন্সপেক্টর: প্রয়োজন হলে তাই করতে হবে। সমাজবিরোধীদের কাছে আমি কিছুতেই মাথা নত করবো না। তুমি সহজ সরল সাধারণ ঘরের ছেলে। তোমার শিক্ষা আছে, আছে শালীনতাবোধ। কেন অনেস্টিকে বিসর্জন দিয়ে অসত্পথে নেমেছো?
মিঃ চোর: আপনার সহানুভূতির জন্য ধন্যবাদ ইন্সপেক্টর। কিন্তু ওই শিক্ষা, আর শালীনতাবোধই আমার দুর্ভাগ্যময় জীবনে চরম বিপর্যয় ডেকে এনেছে।
ইন্সপেক্টর: মিঃ চোর!
মিঃ চোর: জানেন ইন্সপেক্টর! শিয়ালদা স্টেশনে কুলির কাজ করবো বলে গিয়েছিলাম। কত লোক স্টেশন থেকে নামলো। কিন্তু কাউকে আমি মুখ ফুটে বলতে পারলাম না। একটা লাগেজ আমাকে দিন, আমার স্ত্রী আজ তিনমাস রোগ শয্যায় শায়িতা। আজ তিনদিন ধরে আমার ছেলেমেয়েরা না খেয়ে আছে।
ইন্সপেক্টর: হোয়াট ডু ইউ মীন--- কি বলছো তুমি?
মিঃ চোর: যখনই ভাবি, কাউকে বলবো আমার দুঃখের কথা, তখনই মাইকেল বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথের মানসরূপটা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে. ওরা যেন আমাকে ধিক্কার দিতে চায়।কিন্তু ওরা তো জানে না আমার মতো কতো সহস্র শিক্ষিত ছেলেরা অভাবের তাড়নায় বেছে নিয়ে অন্ধকারের পথ।
ইন্সপেক্টর: কিন্তু!
মিঃ চোর: প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষিত বেকারদের জন্ম দিচ্ছে ক্যালকাটা ইউনিভারসিটি। শিক্ষার অভিমান নিয়ে তারা প্রবেশ করছে নতুন জগতে। না পাচ্ছে ভালো চাকরি। বলতে পারেন ইন্সপেক্টর এরা কি করবে? অথচ গোটা পরিবার তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের এই দুরবস্থার জন্য দায়ী কে? দায়ী রাষ্ট্র, দায়ী সমাজ, দায়ী পাড়াপ্রতিবেশী সকলেই।
ইন্সপেক্টর: মিঃ চোর! আমি যদি তোমাকে সরকারী চাকরি দিই, পারবে তুমি চোর্য্যবৃত্তি ছেড়ে দিতে।
মিঃ চোর: না ইন্সপেক্টর, কারণ….
ইন্সপেক্টর: কারণ?
মিঃ চোর: কারণ আমি যা করি তা আমার জন্য নয়, আমার পরিবারের জন্য। অভাবের তাড়নায় আমি ভুলে গেছি আমি সহজ সরল, সাধারণ মানুষ। ভুলে গেছি আমি শিক্ষিত, অনার্স গ্রাজুয়েট। পেটের খিদে নীতিবাক্য মানে না ইন্সপেক্টর। সমাজ দেহের এই ক্ষতটাকে যদি নিরাময় করতে চান, তাহলে মানুষের অভাবকে আগে দূর করুন। নইলে এরাই একদিন সমাজবিরোধী হয়ে জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলবে।
ইন্সপেক্টর: অভাব মানুষের আছে, থাকবে. তাই বলে শিক্ষিত তরুণেরা হবে সমাজদ্রোহী? না মিঃ চোর, তোমার সিদ্ধান্ত আমি মেনে নিতে পারি না। মানবো না।
মিঃ চোর: বিপ্লব আসছে গ্রাম বাংলার ক্ষেতখামার থেকে। দিনে দিনে অভাবী মানুষের পেটের ক্ষুধা যত বাড়ছে, দিনে দিনে বিপ্লব ততই দানা বাঁধছে। এমনি করতে করতে এমন একদিন আসবে, যেদিন, আমার মতো হাজার হাজার, লাখো লাখো শিক্ষিত তরুণ সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা গ্রামবাংলার প্রতিটি কোণ থেকে। পুলিশের লাঠি, বন্দুক, আর পিস্তল দিয়ে তাদের দমন করতে আপনি পারবেন না ম্যাডাম। আই মীন…..
ইন্সপেক্টর: সাট আপ! একজন পুলিশ অফিসারকে কেমন করে সম্মান দিয়ে কথা বলতে হয় তা কি তুমি জানো না?
মিঃ চোর: এ্যা না না মানে… আমি ভুল কর ছিলাম ম্যাডাম আমি ভেবেছিলাম আপনি আমার হারিয়ে যাওয়া সেই অনামিকা যাকে কলেজ জীবনে আমি ভালোবাসতাম। আজ পাঁচ- পাঁচটা বছর ধরে তাকে আমি তন্ন করে খুঁজেছি, কিন্তু পাই নি।
ইন্সপেক্টর: কে অনামিকা? তার সঙ্গে তোমার কিসের পরিচয়?
মিঃ চোর: আমার সারা জীবনের স্বপ্ন। তার সঙ্গে আমার পরিচয় জন্ম-জন্মান্তরের। দুটি অভিন্ন হৃদয়ের ভালোবাসার অটুট বন্ধন।
ইন্সপেক্টর: তোমার নাম সু শান্ত ! সু শান্ত রায় । সেই সুশান্ত কি করে অশান্ত হয়ে ওঠে।
মিঃ চোর: আপনাদের সীমাহীন অভাব কেড়ে নিয়েছে আমার শিক্ষা, আমার সম্ভ্রম, আমার সামাজিক মর্যাদা। তাই আমি শিক্ষিত হয়ে সবার কাছ থে্কে পেয়েছি ঘৃণা আর অপমান। আপনাদের সুসভ্য সমাজ আমাকে কিছুই দেয় নি। নাথিং- কিচ্ছু না। কিন্তু আপনি আমার না জানলেন কেমন করে?
ইন্সপেক্টর: তোমার চোখ, তোমার মুখ তোমার কণ্ঠস্বর বলে দিচ্ছে তুমি সুশান্ত… আমি জানি তুমি চুরি করো নি। তুমি চুরি করতে পারো না।
মিঃ চোর: জানেন ইন্সপেক্টর, ঘরে চাল নেই। স্ত্রীর তিন মাস ধরে ওষুধ কিনতে পারছি না। ছেলেমেয়ে দুটো খিদের জ্বালায় ছটফট করছে। রাত তখন এগারোটা। হঠাত্ ঘুমটা ভেঙে গেল। দেখি স্ত্রী ঘুমুচ্ছে, ছেলেমেয়ে দুটো খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। ভাবলা্ম এই সুযোগ। এই রাতের মধ্যেই আমাকে কিছু একটা করতেই হবে। তা না হলে আমার গোটা পরিবারটা অনাহারে খেতে না পেয়ে মারা যাবে। তাই বাধ্য হয়ে রাতের আঁধারে ঢুকে পড়লাম চৌধুরী পরিবারে। কিন্তু দেখলাম। দরজা জানালা বন্ধ করে সবাই ঘুমাচ্ছে। উঠোনে পড়ে আছে দুটো থালা, বাটি, গেলাস আর ঘটি। তাই সেগুলো নিয়েই পালাতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সামনে পেছনে বামে ডাইনে চারদিক থেকেই গাঁয়ের লোক আমাকে তাড়া করলো। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
ইন্সপেক্টর: সমাজের চোখে তুমি অপরাধী হলেও আমার কাছে তুমি নিরপরাধী। সেপাই। ওর হাতের হ্যাণ্ডকাপ খুলে দাও।
মিঃ চোর: (বিস্ময়ে) ইন্সপেক্টর!
ইন্সপেক্টর: সমাজের বিচারে তুমি অপরাধী হলেও মানবিকতার বিচারে তুমি নিষ্পাপ। তাই তোমার হাত হ্যাণ্ডকাপ খুলে দিলাম। কিন্তু তবুও মুক্ত তুমি নও। আমি তোমাকে কর্তব্যের শৃঙ্খলে তোমায় বন্দী করলাম। আজ থেকে তোমার সাদা পোশাক আমি বদলে দেব। তোমায় পরতে হবে পুলিশের ইউনিফর্ম। আজ থেকে তুমি আমার অ্যাসিস্ট্যাণ্ট। তুমি হবে আইনের রক্ষক কর্তব্যপরায়ন পুলিস অফিসার।
মিঃ চোর: ইন্সপেক্টর!
ইন্সপেক্টর: বিস্ময়ের কিছু নেই বন্ধু! (মাথার টুপি খুলে) চেয়ে দেখ আমার দিকে। চিনতে পারো কে আমি? আমি তোমার চির পরিচিতা অনামিকা সেন। সেদিনের অনামিকা সেন আজকের কর্তব্যপরায়ন মহিলা পুলিশ কমিশনার। তুমি আমার হাত ধরো সুশান্ত। (হাত এগিয়ে দেয়)
মিঃ চোর: (উভয়ে করমর্দন) বলো অনামিকা কি চাও তুমি?
ইন্সপেক্টর: আমি চাই একটা ফুটন্ত সকাল।
মিঃ চোর: আকাশ যে অমানিশার অন্ধকারে ঢাকা।
ইন্সপেক্টর: রাত্রিশেষে আমি নতুন আলোর ঠিকানা এনে দেবো।
মিঃ চোর: অনামিকা!
ইন্সপেক্টর: তোমাকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যাবো। অন্ধকার রাত্রি শেষ হয়ে আসছে। আর দেরি নেই। চেয়ে দেখো পূর্ব দিগন্তে আলোর রক্তিম আভা। নতুন সকাল সূচনা করবে নতুন পথের ঠিকানা।
(উভয়ে একসাথে ফ্রিজ হয়ে যায়। নেপথ্যে মাইকে গান বেজে ওঠে।)
একদিন সূর্যের ভোর
একদিন সত্যের ভোর আসবেই
এই মনে আছে বিশ্বাস
আমরা করি বিশ্বাস
একদিন সূর্যের ভোর আসবেই।
We shall over come
We shall over come
We shall over come someday,
Oh deep in my heart
We do believe
We shall over come someday.
য ব নি কা
রচনাকাল : ৬/৬/২০২০
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।