বসন্তে রং লাগে মনে….. পুলক জাগে হৃদয়ে
হোলি আসিল আজি – সপ্তম পর্ব
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
রাঙা আকাশ, অশোক পলাশ ফুল আর মৌমাছি প্রজাপতির ওড়াওড়ি জানান দেয় বসন্তের আগমনের। সাথে উৎসবের আমেজ যোগ করে দেয় দোলযাত্রা। তাই আর ঘরে থাকা যায় কি? এমন আনন্দঘন দিনে একে অন্যের সাথে সোহাগ-সম্প্রীতি গড়ে তুলবে, এই তো স্বাভাবিক। তাই রবীন্দ্রনাথ গানের কথায় ডাক দিচ্ছেন গৃহবাসীদের এই সৌন্দর্য অবলোকনের, এই দোল উৎসব পালনের। গানের কথায় স্পষ্ট দোলের বৈশিষ্ট্য এবং বসন্তের আগমনী বার্তা।
”ওরে গৃহবাসী
খোল্, দ্বার খোল্, লাগল যে দোল।
স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল।
দ্বার খোল্, দ্বার খোল্।।
রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোক পলাশে
রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত-আকাশে
নবীন পাতায় লাগে রাঙা হিল্লোল।
দ্বার খোল্, দ্বার খোল্।।
বেণুবন মর্মরে দখিন বাতাসে
প্রজাপতি দোলে ঘাসে ঘাসে।
মৌমাছি ফিরে যাচি ফুলের দখিন
পাখায় বাজায় তার ভিখারির বীণা
মাধবীবিতানে বায়ু গন্ধে বিভোল।
দ্বার খোল্, দ্বার খোল্।।”
পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুর শহরে অবস্থিত শান্তিনিকেতন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার জীবনের দ্বিতীয়ার্ধের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেন তার পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত এই শান্তিনিকেতনের আশ্রমে। এখানে বসেই বিশ্বকবি তার অসংখ্য সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করে গেছেন। প্রথম দিকে শান্তিনিকেতনে নাচ-গান ইত্যাদি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বরণ করে নেওয়া হতো বসন্তকে। পরপবর্তীতে দোলযাত্রা যেহেতু বসন্তে উদযাপিত হয়, তাই দোল ও বসন্তবরণ একইসাথে বসন্তোৎসব হিসেবে ধুমধাম করে উদযাপন করা শুরু হলো শান্তিনিকেতনে। ১৯২৫ সালে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং উদ্বোধন করে যান এই উৎসবের। এছাড়া দোলের পূর্ব রাতে হোলিকাদহনের মতোই ‘বহ্নি উৎসব’ পালন করা হয়।
বর্তমানে রবীন্দ্রনাথের ‘ওরে গৃহবাসী’ গানের মাধ্যমেই সূচনা হয় বসন্তোৎসবের এবং দিনভর চলে রঙ খেলা ও নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
শ্রী চৈতন্য দেব ও গৌড়পূর্ণিমা
ফাল্গুনের এই পূর্ণিমা তিথিতেই শ্রী চৈতন্য দেবের জন্ম হয়, তাই একে গৌড়পূর্ণিমা নামেও অভিহিত করা হয়। তাই বৈষ্ণব সমাজে দোলের সাথে সাথে গৌড়পূর্ণিমাও বিশেষ তাৎপর্যের সাথে পালিত হয়।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (১৪৮৬– ১৫৩৪) পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ায় নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন হিন্দু সন্ন্যাসী এবং ষোড়শ শতাব্দীর বিশিষ্ট বাঙালি ধর্ম ও সমাজ সংস্কারক। তিনি মূলত রাধা ও কৃষ্ণ রূপে ঈশ্বরের পূজা প্রচার করতেন। ‘হরে কৃষ্ণ’ মহামন্ত্রটি তিনিই জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন।
কামদেবের প্রত্যাবর্তনে রঙ খেলা
বৈষ্ণবধর্ম ছাড়া শৈব ও শাক্তধর্মেও হোলি উৎসবের রেওয়াজ ছিল। হোলি নিয়ে শিব ও কামদেবের একটি গল্পও প্রচলিত আছে। শিব ছিলেন কঠিন ধ্যানে মগ্ন। তার ধ্যান ভাঙতে এবং স্বামীরূপে শিবকে পাওয়ার জন্য বসন্ত পঞ্চমীর দিন পার্বতী প্রেমের দেবতা কামদেব এবং প্রেমের দেবী রতির সাহায্য প্রার্থনা করেন। কামদেব এবং তার স্ত্রী রতি পার্বতীকে সাহায্য করবেন বলে ঠিক করেন। কিন্তু শিব তখন যোগাসনে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে আছেন। এই ধ্যান ভাঙা খুব কঠিন! কিন্তু পার্বতীর কথা ভেবে কামদেব ও রতি শিবের দিকে তীর ছোঁড়েন। ধ্যানে এই বিঘ্ন ঘটবার কারণে শিব তার তৃতীয় চক্ষু খোলেন এবং সেই চক্ষুর তেজোদ্দীপ্ত চাহনিতে কামদেব দগ্ধ হয়ে ছাইয়ে পরিণত হন। স্বামী হারিয়ে রতি কষ্টে ভেঙে পড়ে। পরবর্তীতে শিব পার্বতীকে বিয়ে না করে, রতির সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিবাহের একপর্যায়ে রতি শিবের কাছে তার স্বামীর প্রাণভিক্ষা চান। শিব সম্মত হয়ে কামদেবকে ফিরিয়ে দেন কিন্তু একটু ভিন্নভাবে তার অবতার হয়।
প্রেমের দেবতার এই ফিরে আসাকে বসন্ত পঞ্চমী উৎসবের চল্লিশ দিন পর হোলি উদযাপিত হয়। দক্ষিণ ভারতে এই কাহিনী অনুসরণ করেই রঙ খেলা পালন করতে দেখা যায়।
দোল উৎসব যেমন প্রাচীন, তেমনই প্রধান একটি উৎসব হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে। হিন্দু অধ্যুষিত যেকোনো স্থানেই বড় পরিসরে রঙ খেলা হয়ে থাকে। তাই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এর হরেক নাম লক্ষ্য করা যায়। যেমন- গুজরাটে ধুলেতি, উত্তর প্রদেশে লাঠ মার হোলি, উত্তরখণ্ডে কুমায়নি হোলি, বিহারে ফাগুয়া, ওড়িশায় দোলা, গোয়ায় শিগমো, মণিপুরে ইয়াওসাং, কেরালায় উক্কুলি এবং নেপালে ফাগু।
প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও দোল বা হোলির তাৎপর্য লক্ষ্যণীয়। লিঙ্গ ও ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষই সামিল হতে পারে এই আনন্দঘন উৎসবে। যে কাউকেই রঙ খেলার মতো অন্যতম উৎসবটি আকৃষ্ট করবে। তাই এই সময়ে দেখা যায় প্রচুর মানুষের সমাগম হয়। যেকোনো প্রকার বৈষম্য ভুলে নিরপেক্ষভাবে রঙে, গানে, নতুনে মেতে ওঠে সকলে।
আসুন, আজ পবিত্র হোলির দিনে খুশির রঙে সবার হৃদয় রাঙিয়ে শুভ হোলির গান গাই আর মেতে উঠি খুশির আনন্দে।
হ্যাপি হোলি, জয়গুরু।
হোলির গান (দ্বিতীয় পর্ব)
কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
এসেছে, হোলি এসেছে,
ফাগুনের ফুল ফুটেছে,
কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া আবীর মেখেছে।
আবীরে ছেয়েছে আকাশ
আজকে প্রভাত বেলা,
সুবাসে ভরেছে বাতাস,
আজকে রঙের খেলা।
ফাগুনে ফাগুয়া আসে,
বাতাসে সুর যে ভাসে,
পলাশ শিমূল খুশিতে রং খেলিছে।
এসেছে, হোলি এসেছে,
ফাগুনের ফুল ফুটেছে,
কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া আবীর মেখেছে।
হোলির দিনে প্রভাতপাখি
গাইছে মধুর সুরে গান,
আমের কুঞ্জে কোকিলেরা
সুরে গাইছে কুহুতান।
ফুলের বনে পাপড়ি মেলে
ফুলকলি সব হোলি খেলে
ফুলের কুঞ্জে পুঞ্জে পুঞ্জে অলিরা এসেছে।
এসেছে, হোলি এসেছে,
ফাগুনের ফুল ফুটেছে,
কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া আবীর মেখেছে।
আজকে দোল পূর্ণিমা
সব গায়ে রং মাখাও।
হৃদয়ে রং লাগে সবার
আবীর রঙে রাঙাও।
এসো, এসো, ভাই
হোলি খেলবো সবাই
রংখেলায় আজকে দেখো সবাই মেতেছে।
এসেছে, হোলি এসেছে,
ফাগুনের ফুল ফুটেছে,
কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া আবীর মেখেছে।
রচনাকাল : ৪/৬/২০২০
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।