বসন্তে রং লাগে মনে….. পুলক জাগে হৃদয়ে
বসন্ত আসিল আজি দ্বিতীয় পর্ব
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
ঋতুরাজ বসন্তের আগমনে প্রকৃতির মতো মানুষের মনেও ছড়িয়ে পড়ে বসন্তের রঙ। বসন্তকে বরণ করে নিতে তাই প্রকৃতির রঙে রঙ মিলিয়ে সবাই মেতে ওঠে উৎসবে। ‘ফুল ফুটুক-আর নাই বা ফুটুক-আজ বসন্ত।’ বাঙালির প্রিয় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বসন্তকে প্রতিভাত করে গেছেন এই একটি বাক্যেই।
বসন্ত আজ এসেছে ফুলবনে, পাতায় পাতায় পল্লবে, পল্লবে। ডালে ডালে পলাশ, শিমুল আর বকুলের সৌরভে শীতের ঝড়া পাতার মর্মরে মর্মরে আজ থেকে ধ্বনিত হবে বসন্তের কোকিলের কহু কহু তান। পৌষ আর মাঘের শীতার্ত দিনগুলোর পরে ফ্লাগুন মাসের প্রথম দিনে বাঙালি বরণ করে নেবে তাদের প্রিয় বসন্তকে।
‘আজি নব বসন্তের প্রভাতের লেশমাত্র ভাগ আনন্দের / লেশমাত্র ভাগ, আজিকার কোনো ফুল/ বিহঙ্গের কোনো গান/ আজিকার কোনো রক্তরাগ/ অনুরাগে সিক্ত করি পারিবো কি পাঠাইতে তোমাদের তরে!’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালি জাতির কাছে বসন্তের প্রথম দিনটিকে এভাবেই সম্বোধন করে গেছেন আজ থেকে এক শ’ বছর আগে।
আজ বেজে উঠবে সুরে সুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই গান‘ফুলে ফুলে দুলে দুলে বহে কে বা মৃদু বায়ে/ কে জানে কিসের লাগি প্রাণ করে হায় হায়।’ রেকর্ডে বেজে উঠবে লতা মুঙ্গেশকরের সেই গান-‘পাখি আজ কোন সুরে গায়/ কোকিলের ঘুম ভেঙে যায়/ আজ কোনো কথা নয়/ শুধু গান/ আরো গান/ আজ বুঝি দু’জনের মন/ কতো সুরে করে আলাপন/ আজ কোনো কথা নয়/ শুধু গান আরো গান…।’
বসন্ত যে যৌবন এ কথা বোঝা যায় পংকজ কুমার মলি্লকের গাওয়া- ‘চৈত্র দিনের ঝরা পাতার পথে দিনগুলো মোর কোথায় গেলো’ কিংবা সত্য চৌধুরীর গাওয়া – ‘তোমার সে ডাকে ঝরা ফুল শাখে ফাগুণ আসিবে ফিরে/ মনে হবে কার প্রেম জেগে রয়…. যেথা গান থেমে যায় ………’ গানের কথাগুলো শুনলে। বসন্তে প্রিয়তমা’র মনে উঁকি দেয়- ‘তুমি বিনা এ ফাগুন বিফলে যায় ‘ কিংবা ‘ আমি তোমারে ভুলি নাই ভুলি নাই প্রিয়া ……….. মনে পড়ে সেই বন জ্যোস্নায় দেখা হয়েছিলো তোমায় আমায় …………’। যিনি যৌবন হারিয়েছেন তিনি যদি মনে করেন -‘ ওগো তাই এই মন যদি বসন্তের গানে ভরে / তবে তোমার কথাই মনে পড়ে/ ওগো তুমি যে হৃদয়ে দাও সাড়া …..’
গানের এই কথাগুলো, তাহলে অতীতের সেই নানা রংয়ের দিনগুলো চোখের পাতায় আবারও ভেসে উঠবে। বসন্ত, যৌবন আর ভালোবাসা যেন এক হয়ে আছে। এই ভালোবাসা মুক্ত বিহঙ্গের মতো এই বিশ্বের চরাচরে, মানুষের হৃদয়ে, প্রকৃতির পরতে পরতে এর অবাধ বিচরণ। ভালোবাসা আমাদের কে শিখায় যুদ্ধ- বিগ্রহ, খুনোখুনি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, সন্ত্রাস আর প্রতিহিংসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। আর এটাও এক ধরনের ভালোবাসা বা প্রেম। যারা মানবতার শত্রু তাদেরকে বুকে আলিঙ্গন করে নেয়াও এক ধরনের ভালোবাসা । বসন্ত মানেই ভালোবাসা আর এই ভালোবাসা আমাদেরকে দেখায় সুখী সুন্দর শান্তিপূর্ণ এক স্বপ্ন।
বসন্তকালকে নিয়ে গান ও কবিতায় ভরে দিয়েছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঋতুরাজ বসন্ত এলে তাই মনে পড়বেই – ‘ নীল দিগন্তে ঐ ফুলের আগুন লাগল, বসন্তে সৌরভের শিখা জাগল’; ‘ বসন্ত তার গান লিখে যায় ধূলির পরে কী আদরে/ তাই সে ধূলা ওঠে হেসে বারে বারে নবীন বেশে’ ; ‘সেই তো বসন্ত ফিরে এল, হৃদয়ের বসন্ত ফুরায় হায়রে’; ‘ ফাল্গুন হাওয়ায় রঙে রঙে পাগল ঝোরা লুকিয়ে ঝরে/ গোলাপ জবা পারুল পলাশ পারিজাতের বুকের পরে’; ‘ ফাল্গুনের পূর্ণিমা এলো কার লিপি হাতে’ ; ‘ বসন্তে আজ ধরার চিত্ত হলো উতলা, বুকের পরে দোলে দোলে দোলে রে তার পরান পুতলা’; ‘ বসন্তে ফুল গাঁথল আমার জয়ের মালা/ বইল প্রাণে দক্ষিণ – হাওয়া আগুন জ্বালা’ ; ‘ওরে ভাই, ফাগুন লেগেছে বনে বনে- ডালে ডালে ফুলে ফুলে পাতায় পাতায় রে’;’ মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে’;’রোদন ভরা এ বসন্ত সখী কখনও আসেনি বুঝি আগে’- ইত্যাদি।
ফাল্গুন এলেই শুরু হয় বসন্তকাল আর এই ফাল্গুনকে নিয়েই কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর গানে দু’টি চরণ হলো- ‘ও মা , ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে, মরি হায়, হায় রে ‘। বসন্তের দিনে কোনো এক কবরস্থানে নয়তো শ্মশান ঘাটে ঢুকে পড়লে মনে পড়বেই লোকান্তরিত প্রিয় মানুষদের মুখখানি। এ জন্য শোকে বিহবল হয় পড়বেন কখনো বা। কৃষ্ণচূড়া তলে কোনো কবর কিংবা সমাধি দেখে হয়তো ভাববেন, এ কী কোনো ব্যর্থ প্রেমিকের সমাধি। আহা কতো ফুল ছড়িয়ে রয়েছে সমাধিতে। নিজ হাতে ফুল ছিটিয়ে দিতে গিয়ে মনে পড়বে-‘ সমাধিতে মোর ফুল ছড়াতে কে গো এলে, সমাধিতে মোর
………. কতবার গিয়ে তব দ্বারে হায় ……….. মনে করো ভিখারি আমারে, ভিক্ষা নাহি দিলে তুমি ফিরায়েছো যারে………’ গানের এই কথাগুলো। তখনতো স্মৃতিতে জাগবে এই গানের অমর শিল্পী গৌরী কেদার ভট্টাচার্য্যের কথা। চট্টগ্রামের সন্তান এই গৌরীকেদার ভট্টাচার্য্য ১৯৪০ সালে ‘নিমাই সন্ন্যাস’ ছবিতে বাউল সাজেন। শেষ জীবনে তিনি তো যোগী হয়ে মন্দিরে মন্দিরে গান গাইতেন – তখন ও তার মনে ছিল বসন্ত। তিনি তো চির বসন্তের কন্ঠ শিল্পী। ফাল্গুন – চৈত্র নিয়ে এই বসন্তকাল তো প্রেমিক – প্রেমিকার মন দেয়া – নেয়ার ঋতু ক্ষণ, তাইতো ওদের মনে উঁকি দেয়-
‘আজ একটি গানের বীণা বাজবে বাজবে দু’টি প্রাণে/ মোর অনেক দিনের আশা আমি বলবো গানে গানে / ফাগুন হাওয়ার মতো আমি বলবো তোমার কানে কানে……….’ চির বসন্তের গানের এই চরণগুলি। ‘তুমি আর আমি’ ছবিতে কানন দেবী গেয়েছিলেন- ‘ফাগুনের উতরোল কী হাওয়া লাগলো / বাতায়নে নিরজনে মুকুলটি জাগলো…. কৃষ্ণচূড়ার বনে কোকিল কী ডাকলো …’; ‘বসন্ত আজ রাঙিয়ে দিল গানে / এই জনমের প্রথম ভালোবাসা’ আর ‘শত বসন্ত মোদের মিলন রাগে/গোলাপের বুকে বিহগীর মুখে জাগে’- গানের এই চরণগুলি জানিয়ে দেয় বসন্ত আর ভালোবাসা যেনো একই বন্ধনে বাঁধা।
মায়াময় বসন্ত সবাইকে কেড়ে নেয় নিজের ভালবাসার মোহে। যেন প্রেমিকা তার প্রেমিককে মায়া বন্ধনী দিয়ে আবদ্ধ করে রাখে, তেমনি নব ফাগুন সবাইকে নিজের মায়ামন্ত্রে আচ্ছন্ন করে রাখে।
নব বসন্ত বাঙালির প্রাণে নতুনত্বে প্রাণ সঞ্চার করুক এটাই হোক বসন্ত বরণের অভিপ্রায়। আসুন, আমরা সবাই নব বসন্তের রঙে রাঙিয়ে তুলি নিজেদের। সাথে থাকুন, পাশে রাখুন।
জয়গুরু! জয়গুরু! জয়গুরু!
নব বসন্তের কবিতা- ২
কবি লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
বসন্তের রং মাখে
কিশলয় তরুশাখে
পবন পরশে দোলে হাওয়ায়।
আমবনে থেকে থেকে
কোকিল উঠিল ডেকে
তরুর শাখায় পাখি গীত গায়।
অজয়ের বালুচরে
সোনা রোদ পড়ে ঝরে
শাল পিয়ালের বনে বাঁশি বাজে,
হৃদয়ে পুলক জাগে
দেহে মনে রং লাগে
প্রকৃতি সাজিছে নব রূপ সাজে।
ফুলবনে ফুল ফুটে
পূবদিকে রবি উঠে
অলিগণ চলে ধেয়ে পুঞ্জে পুঞ্জে,
কোকিলের কুহুতান
ভরে উঠে মন প্রাণ
ডাকিছে কোকিল সুরে আম্রকুঞ্জে।
রচনাকাল : ৪/৬/২০২০
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।