প্রত্যেক রবিবার নিয়ম করে মা কে দেখতে আসে শুভময়।সারা সপ্তাহ কাজের চাপে সময় করে উঠতে পারেনা একদম।তাই রবিবার বিকেলে আসে।
দুবছর ধরে এরকমই চলে আসছে।
স্বামীর মৃত্যুর পর খুব কষ্ট করে মানুষ করেছেন ছেলেকে।কোনভাবেই যেন বাবার অভাব বুঝতে না পারে সে দিকে খেয়াল রেখেছেন।
লোকের বাড়ি তে রান্নার কাজ নিয়েছিল।শরীরে যতটা কুলোবে তার চেয়ে বেশি কাজ নিয়েছিল যাতে ছেলেকে ভাল স্কুলে পড়াতে পারে।আর অন্যদিকে ছেলেকে যাতে কেউ রাধুনীর ছেলে বলে ব্যাঙ্গ করতে না পারে তাই নিজের এলাকার বাইরে গিয়ে কাজ করত।ছেলে জানত মা অফিসে চাকরি করে।অনিতা দেবীও সেভাবেই বাড়ি থেকে বেরোতো।
যতটা সম্ভব ভাল স্কুলে পড়িয়েছে শুভময় কে।যদিও শুভময় পড়ালেখায় বরাবরই খুব ভালো ছিল।তাই পড়াশুনো শেষ করে ভাল চাকরি পেতে খুব একটা কাঠখড় পোড়াতে হয়নি।
চাকরি পেয়েই মা কে কাজ ছেড়ে দিতে বলেছিল শুভময়।
আর অনিতা দেবীও ভেবেছিলেন তাদের সুখের দিন এবার শুরু হল।এতদিনে ভগবান বোধহয় মা ছেলের দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন।
মহা আনন্দে অনিতা দেবী সেদিন রান্নার কাজ গুলো ছেড়ে দিয়েছিলেন।
ছেলে তার মস্ত চাকরি করে,
অফিস থেকে ফ্ল্যাট পেয়েছে,
বড় মুখ করে এসবই বলেছিল কাজের বাড়িতে।আনন্দে আর গর্বে চোখদুটো তার চিকচিক করছিল।কিন্তু সেদিন কি সে জানত এই সুখ খুব বেশিদিনের নয়।
চাকরি পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই রাত্রির সাথে একটা প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে শুভময়ের।আর সেটা বিয়ে পর্যন্ত গড়াতে বেশি সময় নেয়না তারা।তাই মা এর সাথে আলাপ করানোর জন্য রাত্রি কে নিয়ে এসেছিল একদিন।কিন্তু সেদিন প্রথম রাত্রি কে দেখে চমকে উঠেছিল অনিতা দেবী আর রাত্রিও একিরকম ভাবে চমকে উঠেছিল।মনে মনে খুব ভয় পেয়েছিল অনিতা দেবী।সত্যি টা প্রকাশ হওয়ার ভয়।যে সত্যি টা এতদিন লুকিয়ে রেখেছিল ছেলের কাছ থেকে। কিন্তু সেই ভয়টাই সত্যি হয়ে দাঁড়িয়েছিল অনিতা দেবীর সামনে।
অনিতা দেবী কে দেখার পর রাত্রি সঙ্গে সঙ্গে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।যে মহিলা এতদিন ধরে তাদের বাড়িতে রান্না করে এসেছে তাকে কিছুতেই শাশুড়ি হিসেবে মানতে পারবে না সেটা রাত্রি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল শুভময় কে। যদি তাকে বিয়ে করতেই হয় তাহলে তার মা কে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিতে হবে।এই শর্তে রাজি হলে তবেই সম্পর্ক টা নিয়ে ভাববে নতুন করে।
রাত্রির কোন কথাতেই সেদিন প্রতিবাদ করেনি শুভময়।এতদিন বাদে সত্যি টা জানতে পেরে খুব ঘেন্না হয়েছিল মা এর ওপর।রাগে ঘেন্নায় মা কে সেদিন অনেক গুলো কথাও শুনিয়ে দিয়েছিল।আর মা কে এটাও জানিয়ে দিয়েছিল যে রাত্রি কে বিয়ে করার পর তাকে বৃদ্ধাশ্রমে চলে যেতে হবে।একজন রাধুনী কে মা হিসেবে পরিচয় দিতে তারও সন্মানে বাধবে।এতদিন একরকম ছিল কিন্তু এখন সে উঁচু পোস্টে চাকরি করে কত লোকজনের সাথে ওঠাবসা।রাত্রির মত যদি আবার কেউ একই কথা বলে যে ওর মা তার বাড়িতেও রান্না করত।তাহলে কি সন্মান থাকবে শুভময়ের?অনিতা দেবীও কোন প্রতিবাদ না করেই রাজি হয়েছিল বৃদ্ধাশ্রমে যেতে।ছেলের সুখের জন্য এতদিন যে মা লোকের বাড়িতে রান্না করতে পেরেছে নিজের সমস্ত সুখ বিসর্জন দিতে পেরেছে,সেই মা বীনাদ্বিধায় বৃদ্ধাশ্রমে যেতে পারবে না কেন।সন্তানের জন্য মা পারেনা এমন কোন কাজ বোধহয় পৃথিবীতে নেই।তাছাড়া রাত্রির তো কোন দোষ নেই।সেত নিমিত্ত মাত্র।এতদিন তার ছেলেকে সে পড়িয়েছে কিন্তু শিক্ষা দিতে পারেন নি।
প্রায় দুবছর হয়ে গেল অনিতা দেবী বৃদ্ধাশ্রমে আছেন।এই দু বছরে একবারও রাত্রি আসেনি তার শাশুড়ির সাথে দেখা করতে,অনিতা দেবী কোনদিন আশাও করেনি তার পূত্রবধু আসবে।শুভময় রবিবার করে আসে ঘন্টা খানেকের জন্য তার কর্তব্য পালন করতে।অনিতা দেবীও সারা সপ্তাহ অপেক্ষা করে থাকে এই একটা ঘন্টার জন্য।
কিন্তু এই রবিবার শুভ আসছে না দেখে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন তিনি আর ঠিক তখনই বৃদ্ধাশ্রমের দায়িত্বে থাকা সুনির্মল বসু এসে জানালেন আজ মাতৃ দিবস তাই শুভময় ফোন করে বলে দিয়েছে আজ তার স্ত্রী কে নিয়ে শাশুড়ি কে প্রণাম করতে শ্বশুর বাড়ি যাবেন তাই তার নিজের মা কে দেখতে আসার সময় আজ তার হবেনা।এটা শুনে নতুন করে আর কি কোন কষ্ট পেলেন অনিতা দেবী?মুখ দেখে সেটা আর বোঝা গেলনা ।
রচনাকাল : ১০/৫/২০২০
© কিশলয় এবং মনি রায় ঘোষ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।