বোবা কাহিনী
আনুমানিক পঠন সময় : ৫ মিনিট

লেখিকা : স্বাগতা সরকার
দেশ : India , শহর : জয়নগর

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০১৯ , নভেম্বর
প্রকাশিত ২৩ টি লেখনী ৩৩ টি দেশ ব্যাপী ২০৬৮৫ জন পড়েছেন।
দারিদ্রের ভারে ঝুঁকে পড়া তিন নম্বর ঝুপড়ি টা আজ যেন একটু বেশিই ঝুঁকে পড়েছে।অন্ধকারে মুখ গুঁজে থাকা বস্তির সবকটা মানুষ, যারা কিনা বাসি ভোর থেকে অভদ্র, অশ্রাব্য মন্তব্যে ঝগড়ায় পাড়া মাতিয়ে তোলে আর অফিস গোয়িং ফ্ল্যাটের বাবুদের শান্তিপূর্ণ সুখস্বপ্নে দারুণ একটা বাধা সৃষ্টি করে,তারা সবাই গিয়ে আজ জড়ো হয়েছে ঝুঁকে পড়া টালির চালাটার তলায়।পাতলা মেঘের মলাট দেয়া মিষ্টি সকাল টা ধূসর হয়ে পড়েছে ওখানে ।

দুর্ভাগ্যের জেরে ভেঙে পড়ছে বাড়িটা।ভেঙে পড়ছে উৎকন্ঠায়।ছোট -বড় ইঁদুরের গর্তে ভরা মাটির বারান্দায় ভিড় করে মেয়ে পুরুষেরা। ভেসে আসছে মেহনতি মেয়েমানুষগুলোর হাউমাউ কান্নার শব্দ । সো কলড লো ক্লাস সোসাইটির কলার তোলা বিড়ি ভক্ত কালচে ঠোঁট গুলো মাঝে মাঝে নড়ে উঠছে,
- নে নে তাড়াতাড়ি খাট সাজা।বেলা হয়ে এল।একটা সাদা চাদর পেলে-..
মতিমাসির মা ঘর থেকে দুটো ধূপকাঠি এনে বলে,এগুলো জ্বেলে দাও রতনদা,ওর খাটের ধারে।

ঘরের ভেতর বাঁশের তৈরি একটা তক্তোপোষ গোছের ।
তার ওপরে বছর ছয়-সাতেকের বোবা শিশু টা।ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে চারদিকে ।বোবা-দৃষ্টি একবার ওপরে তুলে কি যেন একটা দেখতে পায় সে।মায়ের লাল শাড়ি ।কিন্তু ওটা ওপরের ঐ আংটা থেকে ফাঁসের মত ঝুলছে কেন? ভাবলেশহীন ছেলেটা কি বুঝল কি ভাবল কেউ জানে না । খানিক আগেই ওখান থেকে নামানো হয়েছে ওর মায়ের ঝুলন্ত নিথর দেহটা।ঘুম থেকে উঠেই লোকজন দেখছে সে। রতনকাকা,মতিমাসি,বিরুদা,কমলিদি,পারুলপিসি,পল্টুদাশিবুজেঠু আরো গাদা গাদা চেনা অচেনা মুখ ছাপিয়ে পড়ছে তার ছোট্ট ঘরটাতে।কেউ কেউ আবার তার মায়ের পাশে বসে আছে ।তার মা মেঝেতে শুয়ে ।মা কথা বলছে না।মায়ের চুল খোলা,চোখ বন্ধ । ওরা মায়ের গা টা সাদা চাদরে ঢেকে দিল এবার ।মতিমাসি, কমলিদি ওরা।ওদের চোখ ভর্তি জল। বোবা ছেলে টা কিছু বুঝে উঠতে পারেনা ।একঘর লোকের শোরগোলে কিছু বলতে চাওয়া ওর অস্ফুট ভাষাটা চাপা পড়ে যায়।মতিমাসির আনা ধূপের গন্ধে ম -ম করছে ঘরটা।ধোঁয়াটা উপরে উঠে ক্রমশ গুলোতে থাকে ঘরের মধ্যে ।ধোঁয়াটে হয়ে ওঠে বোবা শিশুটার মনের চৌহদ্দি টাও।

ধোঁয়াশার ওপারে মায়ের নরম-সুন্দর মুখটা আরো পবিত্র মনে হয়।মনে হচ্ছে চোখদুটো এখুনি খুলে যাবে আর উঠে বসে মা তাকে কোলে নেবে,বলবে-খুব খিদে পেয়েছে নারে সোনা? নতুন কাকিমা এবার মায়ের মুখটা পর্যন্ত সাদা চাদরে মুড়ে দেয়।একটা তীব্র চিৎকারে গলা ফাটাতে চায় বোবা ছেলে।কিন্তু একটা কষ্ট বুকে ঠেলে গলা টিপে ধরে তার, মরিয়া হয়ে খাট থেকে নেমে মায়ের মুখ থেকে সাদা চাদর টা সরিয়ে দেয়।মায়ের গলার কাছে এই কালশিটে দাগ টা কিসের ?মায়ের বরফ গালে একটা আবদারে চুমু এঁকে দেয় সে।তবু মা চোখ খোলে না ।হেসে উঠে বসে না। কেন?প্রতিবাদের শেষ চেষ্টা করে তার কন্ঠস্বর ।অবোধ্য কষ্টমাখা আওয়াজে ঘরটা কেঁদে ওঠে ।

মাকে তুলে নিয়ে যায় রতনকাকা,বিরুদা, শিবুজেঠু,মিনির বাবা।পল্টুকাকু তাকে কোলে নেয়।বুড়ো ঠাকমা ডুকরে কেঁদে ওঠে, বলে-যা হারু মায়ের মুখে আগুন দিয়ে আয়। উপর দিকে চেয়ে জলভরা চোখে বলে,জন্ম থেকে মেয়েটা বড় অভাগী।কচি বয়সে বেধবা হল।ছেলেটা বোবা।সারাজীবন মুখপুড়ি এত কষ্ট পেলে ,আর কালরাতে শেয়াল কুকুরে এভাবে ......নরক নয়,হে ভগবান মেয়েটার যেন সগ্গবাস হয় ।....সগ্গবাস হয়।

হারুটা আজন্ম বোবা হলেও অল্প  আধটু শুনতে পায়।কালো কালো তিরপল টালি আর ভাঙা অ্যাসবেস্টস এ ছাওয়া বাড়িগুলো অদৃশ্য হলেও বুড়ো ঠাকমার ডুকরে ওঠা কান্নার শব্দটা হারুর কানে বাজতে থাকে ।বাজতে থাকে সেই অকুণ্ঠ প্রার্থনার সুর।"বল হরি হরিবোলের"সুর করা শব্দটা মিশে যায়,মিলিয়ে যায় রাজপথের হাজারো শব্দের ভিড়ে।

কতক্ষণ হারু ঘুমিয়েছে জানে না।মায়ের মুখে পাটকাঠির নুড়ো জ্বেলে দেবার সময় সেই  যে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল আর কাঁদতে কাঁদতে শিবুজেঠু কখন তাকে কোলে নিয়েছে ,আর খিদের জ্বালায়-কষ্টে কখন সে ঘুমিয়ে পড়েছে শিবুজেঠুর সস্তা দামের বিবর্ণ হয়ে আসা আকাশি কাঁধের জায়গাটায়।

ঘুম থেকে উঠে হারু যখন বাইরে এসে দাঁড়াল তখন বিকেল হয়ে গেছে।তিন নম্বর ঝুপড়ি টা নিস্তব্ধ ।আগের চেয়ে বস্তিটাও বেশ চুপচাপ ।কনে দেখা গোধূলির লালচে আলোর মাঝে মায়ের ফর্সা নরম মুখটা মনে পড়ে যায় তার।মা কি আর আসবেনা তার কাছে।মতিমাসি এসে কোলে তুলে নেয় তাকে।মুখে তুলে দেয় গরীবের শেষ সঞ্চয়টুকু।অতি যত্নে গড়া রুটি আর আলু চচ্চড়ি র টুকরো।

রাতে শুয়ে শুয়ে হারু আবার দুঃস্বপ্ন দেখে ।কিন্তু এ কি?এ কি দেখছে সে?এ তো স্বপ্ন নয়,সত্যি ।এ তো গতরাতের ঘটনা ।মানুষের পোশাক পরা কয়েকজন কালো রাক্ষস তার গরীব নিরীহ মায়ের ওপর অত্যাচার করছে।একজন প্রচন্ড জোরে মায়ের বুকে লাথি মারল।মা ছটকাচ্ছে।মায়ের কষ্ট হচ্ছে খুব।ওরা মায়ের মুখ বেঁধে দিয়েছে ।হারুরও কষ্ট হচ্ছে ।খুব দুঃখ হচ্ছে মায়ের জন্যে ।ও চিৎকার করতে চাইছে।-ছেড়ে দাও তোমরা আমার মাকে?কি করেছে আমার মা?ও বলতে চাইছে।কিন্তু ও যে বোবা।মায়ের নরম শরীরটা পিষে যাচ্ছে ওদের শরীরের চাপে।অসহ্য দৃশ্য টা হারুর চোখের পাতা টিপে ধরল।একজন ঠেলে হারুকে ফেলে দিল বাইরের বারান্দায়।হারুর ছোট্ট পা দুটো দরজায় লাথি মারল।মায়ের সেই বাঁচার আকুতি,যন্ত্রণায় নীল হয়ে আসা অসহায় মুখটা....

চমকে উঠে হারুর ঘুমটা ভেঙে গেল।মতিমাসির উষ্ণ মমতামাখা হাতটা ঘুমের ঘোরে হারুর বুকে এসে পড়েছে।মতিমাসি কে আজ ঠিক মায়ের মত দেখাচ্ছে ।নরম পবিত্র মুখ,একরাশ কালো চুলে ঢাকা ছোট্ট কপাল,বন্ধ করা বড় বড় চোখ,ছোট্ট লাল ঠোঁট ।ওরা আবার আজ আসবে না তো?ঘরের এককোণে পড়ে থাকা রক্তমাখা শাড়িতে চোখ পড়তেই শিউরে ওঠে হারু।পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ায় মাটির বারান্দায়।বড় বড় ফ্ল্যাট গুলো দেখাচ্ছে যেন রূপকথার প্রাসাদপুরী।ওদের পিছনে ঢাকা পড়েছে গোল থালার মত চাঁদটা।চাঁদ ও বুঝি আজ আলো দেবে না তিন নম্বর ঝুপড়ি টার মাথায়?ধুয়ে দেবে না অত্যাচারের ক্ষতগুলো?হারুর কষ্টের স্মৃতি বা ধর্ষণের প্রাতিষ্ঠানিক চিহ্নগুলো?কে জানে ।

হারুর ড্যাবড্যাবে জলভরা চোখের সামনে হঠাৎ ই ঝাপসা হয়ে আসে মিটমিট করা তারাগুলো।আকাশের ঘন কালো অন্ধকার টা চলকে চলকে এসে পড়ে তার ছোট্ট বুকে।এত শত বোঝেনা বোবা ছেলেটা।ঠিকানা পেলে সে একবার মায়ের কাছে যেত।বুকফাটা চিৎকার করে  একবার গুমরে উঠতে চায় হারু।নিষ্পাপ চোখে আকাশের কাছে জানতে চায়,

-স্বর্গের রাস্তা টা কোনদিকে?নরকটাই বা কোথায়?
রচনাকাল : ১০/৫/২০২০
© কিশলয় এবং স্বাগতা সরকার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 7  China : 33  Europe : 1  France : 9  Germany : 2  India : 193  Ireland : 43  Norway : 1  Romania : 1  Russian Federat : 4  
Saudi Arabia : 7  Sweden : 12  Ukraine : 10  United States : 297  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 7  China : 33  Europe : 1  France : 9  
Germany : 2  India : 193  Ireland : 43  Norway : 1  
Romania : 1  Russian Federat : 4  Saudi Arabia : 7  Sweden : 12  
Ukraine : 10  United States : 297  
লেখিকা পরিচিতি -
                          স্বাগতা সরকার ২রা মার্চ পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪-পরগণা জেলাস্থিত বিখ্যাত জয়নগর শহরের মাজিলপুর অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন।

বর্তমানে তিনি প্রাণীবিদ্যা বিষয়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর বিভাগে পাঠরতা। ছোটোবেলা থেকেই সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি আবৃত্তিতে, শ্রুতিনাটকে, সঙ্গীতে, চিত্রাঙ্কনে তিনি সমানভাবে পারদর্শীনী। তার লেখা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সাহিত্যের বিভিন্ন বিভাগে যেমন কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, নাটক, শ্রুতিনাটক ইত্যাদিতে এনার লেখনীর পারদর্শীতা লক্ষ্য করা যায়। তিনি বিভিন্ন অনলাইন পত্র-পত্রিকাতেও লেখালেখি করেন। 
                          
© কিশলয় এবং স্বাগতা সরকার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
বোবা কাহিনী by Swagata Sarkar is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫৪০৬২২
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী