পেত্নীর স্বয়ংবর - প্রথম পর্ব
আনুমানিক পঠন সময় : ৬ মিনিট

লেখিকা : সায়ন্তী সাহা
দেশ : India , শহর : সিঙ্গুর

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০১৯ , ডিসেম্বর
প্রকাশিত ২৫ টি লেখনী ২৭ টি দেশ ব্যাপী ১৪৬৬৯ জন পড়েছেন।
জানেন,বেঁচে থাকাকালীন না ফেব্রুয়ারি মাসটার ওপর আমার চরম বিতৃষ্ণা ছিল,কিন্তু সেই ফেব্রুয়ারি মাসেই যে আমার এমন প্রাপ্তিযোগ হবে তা আমি আগে থেকে বুঝব কিকরে!!ব্যাপারখান বুঝলেন না তো,দাঁড়ান তাহলে শুরু থেকে ব্যাপারটা আপনাদের একটু খোলসা করে বলি।

আমি সায়ন্তী সাহা,চন্দননগর কলেজে প্রাণীবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করছিলুম,বয়স?তা কত আর হবে ওই বছর কুড়ি।তো এই কুড়ি বছর বয়সেই আমার ছিল চরম দুঃখু।যা তা দুঃখু নয় গো আমার যা তা দুঃখু নয়,দেখতে দেখতে হুশ করে কুড়িটা বসন্ত পেরিয়ে তো গেল,কিন্তু আমার কপালে একখান ছেলেও জুটলোনি?হে রগুবীর!!এ কষ্ট আমি রাখব কোথায়।বান্ধবীরা যখন তাদের প্রেমিকদের নিয়ে গঙ্গার পাড়ে সময় কাটাতে ব্যস্ত,তখন আমি?আমি তখন কলেজের লাইব্রেরীতে বসে বসে,দুলে দুলে রূপার্ট আর বারনেস থেকে অর্থোপোডার সিসটেমেটিক পজিশন মুখস্থ করছি।আমার কষ্টটা মনে মনে একবার কল্পনা করে দেখুন আপনারা।আমি জানি, আমি জানি,আমার দুঃখে আপনাদেরও চোখে জল আসছে,আচ্ছা ঠিকাছে ঠিকাছে!!কাঁদতে হবে না আর,শুনুন তারপরের ঘটনা।

তো গরিবের জীবনটা যখন এহেন বিভিন্নরকম প্রতিকূল ঘটনা দ্বারা জর্জরিত,ঠিক সেই সময়েই,সেই সময়েই কাটা ঘায়ে নুনের ছিঁটে দেওয়ার জন্য বছর বছর উপস্থিত হত এই ফেব্রুয়ারী মাস।এইমাসেই হাজারো একটা স্পেশাল দিন নিয়ে চলে একসপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন দিন উদযাপন,কিসব কিসব দিন বাবা,টেডি,রোস,চকোলেট,প্রমিস,ভাভাগো ভাভা!! একটা চকোলেট দেওয়ার জন্য কিনা আস্ত একখান দিন!!ভাবা যায়,অথচ আমাকে যদি কেউ কস্মিনকালেও একটা পালস খাওয়াত, দুঃখের কথা কি আর বলি।

বিশ্বাস করুন এমনিতেই ছেলেপুলেরা একসাথে হাত ধরে ঘুরে বেড়ানোর জন্য লক্ষ্মীপূজো থেকে কার্তিকপূজো,নাগপঞ্চমী থেকে বসন্তপঞ্চমী একদিনও ছাড় দেয় না,উপরন্তু তেনাদের জ্বালায় এখন বসন্তউৎসব আর নববর্ষটাও বাদ যাচ্ছেনা,সেখানে আমার মতো একাকী মানুষগুলোর কষ্টটা আশা করি আপনাদের বোঝাতে পারছি।জানি এহেন কষ্টের কাহিনী শুনে আপনারা আপনাদের চোখের জল ধরে রাখতে পারছেন না,তাহলে একবার ভাবুন আমার মনের অবস্থাটা কি হয়!!

আমার কলেজের সামনেই চন্দননগরের বিখ্যাত স্ট্রান্ড রোড,এই সাতদিন সেখানে ঢল নামে হাজার হাজার মানুষের,সকলেই জোড়ায় জোড়ায় ঘুরে বেড়ায় আর আমি শুধু তৃষাতুর  চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে সেসব দেখি,তা ছাড়া যে আমার আর কোনো উপায়ও নেই।

তাই এবারে,আগে ভাগেই বছরের শুরুতে মনে মনে একটা ফন্দি এঁটে রেখেছিলাম আমি।আগে থেকেই ঠিক করেছিলাম,এবছর জোড়ায় জোড়ায় ছেলেপুলেদের দেখলেই তাদের উদ্দেশ্যে আমি ঢিল ছুঁড়ে মারব আর তারপরে টুক করে লুকিয়ে পরব গাছের আড়ালে।যেমনি ভাবা তেমনি কাজ।

সেইমতো ১৪ তারিখ ব্যাগ ভর্তি ঢিল নিয়ে আমি হাজির হলাম স্ট্রান্ড রোডে,মিশন "ছুঁড়ে মারো"কে যে করেই হোক সাকসেসফুল করতেই হবে।বেশি দূর যেতে হলোনা,সামনেই দেখতে পেলাম একটা ছেলে একটা মেয়ের হাত ধরে বেঞ্চে বসে আছে,দুজনেই দাঁত বের করে হ্যা-হ্যা করে হাসছে।বুঝতে পারলাম দুঃখে আমারও বুকের ভিতরখান ব্যথায় টনটন করছে।মনে মনে বললাম,

"উমমমমম!!আদিখ্যেতা দেখলে বাঁচি না আর,ন্যাকাআআআ"

আর তারপরই সুযোগ বুঝে আমিও ব্যাগ থেকে দুখান ঢিল বের করে দুটোকে টিপ করে ছুঁড়ে মারলাম।আর তারপর দে দৌড়। পাশেই একটা গাছের আড়াল থেকে লুকিয়ে দেখলাম দুজনেই চরম ভয় পেয়েছে,বেঞ্চ থেকে হুড়মুড়িয়ে উঠে এদিক ওদিক ওপর নীচে তাকিয়ে দুজনেই ব্যাপারটা কি হল সেটা বোঝার চেষ্টা করছে,তারপর কি বুঝল জানিনা,দেখলাম দুজনেই হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল।মনটা আনন্দে ভরে উঠল।
"আহা!!কাঠি করেও এতো সুখ!!আগে যদি জানতাম"

তারপরে আমি সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম,ইতিউতি তাকিয়ে দেখি,সামনে আরেকটা প্রেমিকযুগল,এবারেও একইঘটনার পুনরাবৃত্তি হল,বেশ মজা পেলাম,আস্তে আস্তে ব্যাগের মধ্যে থাকা ঢিলসংখ্যা কমতে শুরু করল,ঢিল যখন একেবারে তলানিতে তখনই ঘটল সেই অঘটন,ছোটাছুটি করে বারবার লুকাতে গিয়ে ইঁটে পা লেগে খেলাম এক মোক্ষম হোঁচট,মুখ থুবড়ে পরলাম মাটিতে আর তারপর চোখে নিকষ কালো অন্ধকার নেমে এল।

চোখ খুলতেই দেখলাম একজন ভীষণদর্শন পুরুষ এবং একজন পাটকাঠির মতো লিকলিকে মহিলা আমায় চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে কোথায় যেন একটা চলেছে,ওনাদেরকে দেখেই আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে গেল,অস্ফুটেই গাঁক গাঁক করে চিৎকার করে উঠলুম।

হতচ্ছাড়া মিনসেগুলো আমার চিৎকারে হতভম্ব হয়ে আমাকে সজোরে ফেলে দিল মাটিতে,দড়াম করে শব্দ করে মাটিতে পরলাম,কিন্তু আশ্চর্য হয়ে গেলাম এটা দেখে যে আমার একটুও কোথাও ব্যথা লাগল না।কি কপাল মাইরি!!কোনো হ্যান্ডসাম দেখতে স্মার্ট ছেলেও তো আমার জ্ঞান ফেরাতে পারত নাকি!!!তা নয়,কোথাকার কোন দুই হরিদাস পাল আমাকে কিডন্যাপ করার ছক কষছে!!কথায় নাকি বলে,"ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও...."বাকিটা আর মনে পড়ছিল না।মাটি থেকে উঠে গা থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বেশ ঝাঁঝের সাথেই বললাম,

"হ্যাঁ রে মুখপোড়া মিনসে,তোর বাড়িতে মা বোন নেই রে?ছ্যাঁ-ছ্যাঁ-ছ্যাঁ রাস্তায় একা একটা মেয়েকে দেখলি কি দেখলি না তাকে নিয়ে নোংরামি করতে লজ্জা করে না?তোদের এই মনোভাবের জন্য দেশটা আজ রসাতলে গেল...আর এই যে বোন!! তুমি না মেয়ে? একজন মেয়ে হয়ে অন্য একটা মেয়ের সর্বনাশ করতে লজ্জা করে না তোমার...."

"এই চুপ!!একদম চুপ,একদম ফালতু বকবিনা"আমাকে শেষ করতে না দিয়েই দাবড়ে উঠল লোকটা।

ওরকম ভাঙা কলসির মতো কর্কশকন্ঠের দাবড়ানি শুনে আমি আর থাকতে পারলাম না,ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললুম।আমার কান্না শুনে ওই হতচ্ছাড়া পাজী লোকটা আরো রেগে গেল,চেঁচিয়ে উঠে বলল,

"এই তুই তোর মরাকান্না থামাবি?নাকি আমি চাবকে তোর পিঠের ছাল চামড়া তুলে নেব?"ওনার এইকথা শুনে আমি ফিক করে না হেসে আর পারলাম না,ওড়নার খুঁট দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললাম,
"তা কাকু বুঝি রঞ্জুজ্যেঠুর বিশাল বড়ো ফ্যান?"

মরা মাছের মতো মুখ হা করে লোকটা আমার দিকে এমন করে তাকিয়ে রইল যেন আমি কোনো স্পিসিসের সাইন্টিফিক নাম বলেছি,কিছুক্ষণ পরে ঘোর কাটিয়ে বলল,
"আমাদের ওখানে রঞ্জু না সঞ্জুর রাজ চলে আর আমি সঞ্জুর বিশাল বড়ো ফ্যান।"

সঞ্জু বলতে কি উনি সালমান খানকে বোঝাতে চাইছেন?সেটা জিজ্ঞেস করার আগেই উনি বলতে শুরু করলেন,
"শোন মেয়ে তখন থেকে তুই বহুত নাটক করছিস,আমরা তোকে সহ্য করছি মানে এই নয় তোকে যমরাজও সহ্য করবে,আর কিছুক্ষণ পর আমরা যমের দক্ষিণ দুয়ারে পৌঁছাব,ওখানে গিয়ে একটাও ফালতু কথা বলবি না,মহারাজ কিন্তু ডেঁপোমি একদম পছন্দ করে না,তখন যদি তোকে নরকের গরম তেলে ডুবো ডুবো করে ভাজা করার আদেশ দেয়, খবরদার তখন আমাকে এটা বলতে আসবি না যে আমি তোকে আগে থেকে সাবধান করিনি।"

ব্যাপারটা কি হল আমি তখনও বুঝতে পারছিলাম না, মাঝখানে যমরাজই বা এলো কোত্থেকে? ইয়ার্কি হচ্ছে না কি?

দ্বিতীয়জন যিনি এতোক্ষণ চুপ করে ছিলেন মনে হয় আমার অবস্থাটা বুঝতে পেরেছেন,এগিয়ে এসে বললেন,
"ব্যাপারটা এখনো বুঝতে পারনি বোন?আমি বুঝতে পেরেছি,প্রথম প্রথম কেউই বুঝতে পারেনা গো,কতো বয়স্ক বয়স্ক মানুষ স্বীকার করতে চায় না তারা মরে গেছে আর তুমি তো কচি মেয়ে!অাহা রে!!!না জানি কতো শখ অপূর্ণ থেকে গেল অভাগীর।"এই বলে ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে তিনি কাঁদতে লাগলেন।

"কিইইই!!আমি মরে গেছি?কখন?কোথায়?কিভাবে?"-চমকে উঠলাম আমি।

"উমম!!নাটক!!মরে গেছে অথচ উনি জানেন না উনি মরে গেছেন,বলি এটা কি অপেরা নাকি রে,যে তুই এখানে নাটক করছিস?ন্যাকা..."ঝাঁঝিয়ে ওঠে প্রথমজন।

"আহ্ পটলা তুই থামবি, বুঝতে পারছিস না মেয়েটার এখনো ঘোর কাটেনি, তুই থামতো বাপু, আমি ওকে বোঝাচ্ছি,"এই বলে সেই মহিলা শুরু করেন,

"শোন মেয়ে,আমি আর ও হলুম গিয়ে দুই যমদূত,আজ দুপুরেই হোঁচট খেয়ে তুমি পটল তুলেছ, তাই আমরা দুজন তোমায় আনতে এসেছি, এখন আমরা যমরাজের কাছে যাচ্ছি,সেখানে গিয়ে তোমার সমস্ত পাপ পুণ্য হিসাব হবে, বুঝেছ?"

আমি চিৎকার করে হাত পা ছুড়ে কেঁদে উঠলাম,
"আমি এত তাড়াতাড়ি মরতে চাই না, আমার এখনো প্রেম করা বাকি,বিয়েটাও তো করা হল না,এসব না করে আমি মরব না, এটা ঠিক না, এটা চিটিং"

তারা আমার কোনো কথাই শুনল না,আগের মতনই পুনরায় চ্যাংদোলা করে আমায় নিয়ে চলল' কোনো এক অজানা গন্তব্যে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম জায়গাটা খুব একটা সুবিধার না। আমার ভীষন ভয় লাগছিল।

কিছুক্ষণ পরেই একটা প্রকাণ্ড দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম, পটলা নামের লোকটি দরজা দিয়ে ভেতরে চলে গেল, আমি আর ওই মহিলা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম। মহিলাটি আমার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হেসে বললো,
"চিন্তা নেই,চিন্তা নেই,আমাদের মহারাজ খুবই দয়ালু, তাকে বলিসখনে তোর মনের কথা, তোর বিয়ে স্বয়ং মহারাজ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দেবেন। প্রেতলোকে কি আর ছেলের অভাব!!"

কেন জানিনা এটা শুনে মনের মধ্যে হাজারো প্রজাপতি ডানা মেলে উড়তে শুরু করল। মরে যাওয়ার সমস্ত শোক এক লহমায় কোথায় যেন হারিয়ে গেল, বরং প্রেম করার জন্য মহারাজ নিজে ছেলে খুঁজে দেবেন শুনে কৃতজ্ঞতায় আমি কি বলব সেটা ভেবে পেলাম না। যাইহোক বাবা মরে গিয়ে কিছু তো উপকার হয়েছে, ততক্ষণে দেখলাম পটলাও ফিরে এসছে, ওদের সাথে নাচতে নাচতে আমি যমপুরীতে প্রবেশ করলাম।

ক্রমশঃ
বিঃদ্রঃ::গল্পে উল্লিখিত সমস্ত কাহিনী এবং কথা সবটাই কল্পনা, কাউকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলা নয়, লেখার মাধ্যমে পাঠক মনে আনন্দ দেওয়াই একমাত্র উদ্দেশ্য,কারো মনে আঘাত লেগে থাকলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
রচনাকাল : ১৬/৪/২০২০
© কিশলয় এবং সায়ন্তী সাহা কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Austria : 1  Bulgaria : 1  Canada : 5  China : 109  France : 7  Germany : 35  India : 770  Ireland : 9  Norway : 1  Romania : 6  
Russian Federat : 23  Saudi Arabia : 9  Spain : 1  Sweden : 108  Ukraine : 43  United States : 483  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Austria : 1  Bulgaria : 1  Canada : 5  China : 109  
France : 7  Germany : 35  India : 770  Ireland : 9  
Norway : 1  Romania : 6  Russian Federat : 23  Saudi Arabia : 9  
Spain : 1  Sweden : 108  Ukraine : 43  United States : 483  
© কিশলয় এবং সায়ন্তী সাহা কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
পেত্নীর স্বয়ংবর - প্রথম পর্ব by Sayanti Saha is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫৪০৫৬৬
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী