ভালবাসা শুধু ভালবাসা
দ্বিতীয় খণ্ড পঞ্চম পর্ব।
ভালবাসার বালুচরে খেলাঘর
লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
ভালবাসার বালুচরে বাঁধা খেলাঘর। তিল তিল করে প্রেম, প্রীতি আর ভালবাসা দিয়ে গড়ে তোলা হয় জীবন নদীর বালুচরে ভালবাসার খেলাঘর। অবিচারের ঝড় এসে যখন ভেঙে দেয় সেই খেলাঘর তখন পাথরের চোখেও অশ্রু ঝরে। আসুন, আজ আপনাদের নিয়ে যাব আমি ভালবাসার বালুচরে বাঁধা খেলাঘরে। যেখানে আনন্দের অশ্রুধারা বইবে স্বপ্নের সাজানো বাগানে।
জীবন নদীতে ভেসে চলেছে প্রেমের তরী। প্রেমের তরী জলে ডোবে না। মনমাঝি তাই ভাটিয়ালী সুরে গান ধরেছে
“জীবন পথের পথিক রে তুই—
বাঁধলি কেন ভালবাসার খেলাঘর?
জীবন নদীর ঝড় তুফানে
ভাঙবে রে তোর সেই খেলাঘর।
……………………………ও মন রে-------- মন রে আমার….
জীবন নদীর তটে তরী এসে ভিড়ে কিনারায়। তরী থেকে নেমে আসে নব-দম্পতি। কোথায় যাবে ওরা? ওরা নিজেই জানে না। উদ্দেশ্য-বিহীনভাবে নব-দম্পতির যাত্রা হয়েছে শুরু। নদীর তটে বিনু দাসের চায়ের দোকান। চোখের মোটা ফ্রেমের চশমা খুলে নব দম্পতিকে দেখে। কিছু পরেই ধূতি পাঞ্জাবী পরিহিত নব-যুবক তার দোকানে এসে বলে চা হবে। সকাল সকাল চা না খেলে ভাল দিন শুরু হয় না। তাই নব-যুবক চায়ের দোকানে দুটি চায়ের অর্ডার দিল।
বেনারসী শাড়ি পরিহিতা নব-যুবতীও তার পাশে এসে দাঁড়ায়। চায়ে চুমুক দিতে দিতে নবদম্পতি লক্ষ্য করে নদী কিনারায় লাগানো নৌকাটি ওপারের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিচ্ছে। এপারের নদীর কিনারায় প্রকাণ্ড একটা বটগাছের ডালে বাসা বেধেছে দুটি বিহগ-বিহগী। এরা বেশ সুখেই আছে। কেউ ওদের কিছু বলে না।
ওরা ভাবে- এই রকম স্থায়ী ঠিকানা যদি তাদের থাকত। যদি তারাও এরকম সংসার বাঁধতে পারতো তাহলে কি ভালোই না হতো। ভাবতে ভাবতে নবদম্পতি অন্যমনস্ক হয়ে যায়। চকিতেই দোকানের মালিক বিনু দাস জিজ্ঞাসা করে- “আপনারা কোথা থেকে আসছেন আরা কোথায় যাবেন?”
কিছুটা অপ্রস্তুত পরিস্থিতিতে পড়লো এবার নব-দম্পতি। কিছু না বলে নব- যুবক চায়ের দাম মিটিয়ে বললো – ধন্যবাদ। আবার যাওয়ার পালা। দুজনে রাঙাপথ ধরে হাঁটতে থাকে। গাঁয়ের রিক্সাওয়ালা কলিম মিঞা এই পথে প্রতিদিন রিক্সা নিয়ে যাতায়াত করে। দাঁড়িয়ে যায়। বলে- “কোথায় যাবেন বাবু! আসুন আমি পৌঁছে দেব।”
কিছু না বলেই ওরা দুজনে বসে এসে রিক্সায়। রিক্সা ছুটে চলেছে। কিন্তু কোথায়? রিক্সাওয়ালাও জানে না। রিক্সাওয়ালা জিজ্ঞাসা করে- কোথায় যাবেন আপনারা? এবার কি উত্তর দেবে রিক্সাওয়ালাকে ওরা জানে না। অগত্যা রিক্সাওয়ালা রাঙা রাস্তার চৌমাথায় রিক্সা থামিয়ে বলে- কোন গাঁয়ের লোক আপনারা? কোন গাঁয়ে যাবেন? কেননা এই চৌমাথায় রাস্তা আলাদা আলাদা গাঁয়ে গিয়ে মিশেছে।
ঠিক সেই সময় গাঁয়ের জমিদার ভুবন নারায়ণ রায় ঘোড়ার গাড়ি করে চলেছেন নিজের কাছারিতে। সাথে নায়েব হরিহর নাথ। চোখে গোল ফ্রেমের চশমা। জমিদার ভুবন নারায়ণ রায় তার নায়েব মশাইকে জিজ্ঞেস করেন- এই নব-দম্পতি কোথায় যাচ্ছেন? ঘোড়ার গাড়ি তাদের গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। সহাস্যে জমিদারবাবু সাদরে ডেকে নিলেন নব-দম্পতিকে।
তাঁদের উদ্দেশ্যে বলেন – “আমার স্ত্রী নেই, আমার পুত্র নেই, আমার বিশাল সংসারে আমি একা। তাই তোমাদের আমি আমার পুত্র ও পুত্রবধূর মর্যাদা দিয়ে আমার কাছে রাখতে চাই। এসো তোমরা।”
কূল ভাঙা ঢেউ যখন সবকিছুকে প্রবল বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়, যখন আশ্রয়হারা বিহঙ্গের সকরুণ আর্তনাদ আমাদের হৃদয়ের গভীরে গিয়ে অন্তরটাকে তোলপাড় করে দেয়, ঠিক তখনই তারা পায় বাঁচার ঠিকানা। ঠিক তেমনি নব-দম্পতিকে আশ্রয় দিলেন স্থানীয় জমিদার ভুবননারায়ণ রায়। শুধু তাই নয় তাঁদের পরিচয় এখন ওরা জমিদার পুত্র ও পুত্রবধূ।
এরপর তিনটি বছর পার হয়ে গেছে। সারা গাঁয়ে আজ আনন্দের ঢেউ। আজ জমিদার ভুবন নারায়ণ রায়ের নাতির অন্নপ্রাশন। কত লোক খাবে। চারদিকে ময়রা, রাঁধুনি, ও কাজের লোকের হৈ চৈ। প্যাণ্ডেল টাঙানো হয়েছে। রাতেও লোকের আতিথ্যে ভরে উঠবে তার সুখের রাজপ্রাসাদ। ভালবাসার বালুচরে বাঁধা খেলাঘর এত সুখের হতে পারে তা দম্পতি-যুগল স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারে নি।
রচনাকাল : ১২/১১/২০১৯
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।