ভালবাসা শুধু ভালবাসা (ষষ্ঠ পর্ব)
শাঁখা সিঁদুর আলতা
লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
“তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হয় নি, হয়েছে মালা বদল। মালা বদল বিয়ে নয়, এ বিয়ে আমি স্বীকার করি না”--কৌশিক গর্জে ওঠে।
সন্ধ্যা নিরুত্তর। কোন প্রতিবাদ করে না। তার ফল হলো উল্টো। কৌশিক আরো ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল। বললো- “আমি ভেঙে দেবো তোমার হাতের শাঁখা, মুছে দেবো তোমার সিঁথির সিঁদুর। ”
রাত তখন বারোটা। মধ্যরাত্রিতে আকাশে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে বারান্দায়। জোছনার আলোয় সন্ধ্যাকে খুবই সুন্দরী লাগছে। নিঝুম রাত। বাড়ির সবাই ঘুমোচ্ছে। শুধু জেগে আছে এক সদ্য বিবাহিত তরুণ আর এক সদ্য বিবাহিতা তরুণী, সন্ধ্যা আর কৌশিক। সন্ধ্যার দুচোখ জলে ভরে আসে।
কৌশিক নেশার ঘোরে চিত্কার করে ওঠে- যাও, আর মায়াকান্না কাঁদতে হবে না। রাত হয়েছে, আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ো। চোখের জল মুছতে মুছতে সন্ধ্যা ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। কাউকে কিছু বলার নেই। হিতে বিপরীত হবে জেনে সে কোন প্রতিবাদ করে না।
আর একটা বোতল শেষ করে কৌশিক গান ধরে- “টাকার নেশায় সবাই পাগল (বুঝলে গো বাবুরা)
আমি পাগল নেশার ঘোরে।
টাকার নেশায় … … …”
অধিক উত্তেজনার বশে ধড়াম করে দরজায় ধাক্কা মারে। সেই শব্দে জেগে ওঠে সন্ধ্যা। দেখে কৌশিক টলছে। সন্ধ্যা তাকে ধরতে যায়।
কৌশিক চিত্কার করে ওঠে- “ছোঁবে না, আমাকে তুমি স্পর্শ করবে না। তোমার নিঃশ্বাসে বিষ, হৃদয়ে আছে তীব্র হলাহল, সেই বিষের জ্বালায় আমি জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছি”।
বেরিয়ে যাও বাড়ি থেকে। আর কোনদিন এ বাড়ির দরজায় পা রাখবে না। জোর করে ঠেলে বের করে দেয় সন্ধ্যাকে। সন্ধ্যা বিপর্যস্ত বসনে বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ায়।
নিশুতির রাতের অন্ধকারে কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করছে। জনমানবশূণ্য রাজপথ। রাস্তার লাইটপোস্টের নীচে আলোর সামনে একঝাঁক ঝিঁঝিঁ পোকারা উড়ে বেড়াচ্ছে।
ল্যাম্পপোস্টে আলোর সামনে দাঁড়িয়ে আছে সন্ধ্যা। হঠাত্ একটা পুলিশ ভ্যান এসে থমকে দাঁড়ায়। ভ্যান থেকে নেমে আসে পুলিশ অফিসার সুদীপ সান্যাল। সন্ধ্যা অশ্রুসজল চোখে তার দিকে তাকায়। ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে সন্ধ্যা। কাঁদতে কাঁদতে বলে- “আপনি আমাকে বাঁচান পুলিশ অফিসার। আমি এক সদ্যবিবাহিতা নির্যাতিতা গৃহবধূ। আমার জীবন বিপন্ন।”
- “কোন ভয় নেই আপনার। আমরা আপনাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করবো। কি সাহায্য চান আপনি?”
- “অন্যায়ের প্রতিশোধ। অর্থের অহংকারে যারা, গৃহবধূদের শাঁখা, সিঁদুর ও আলতার উপযুক্ত মর্য্যাদা দেয় না, আমার মত লজ্জাশীলা গৃহবধূদের প্রতিনিয়ত অপমান করে, তাদের মত অহংকারী স্বামীদের আমি আদালতের কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে বিচার চাইবো।”
- “আমরা প্রস্তুত। আসুন আপনি থানায়। একটা এফ আই আর লিখিয়ে যান আর কাল ভোরে আপনাকে আপনার বাড়িতে আমরা নিজেই এসে পৌঁছে দিয়ে যাব।”
ভীত সন্ত্রস্ত পদে সন্ধ্যা পুলিশের ভ্যানে এসে বসে। পুলিশ অফিসারের নির্দেশে ভ্যান থানার দিকে রওনা হয়।
গল্প এখানেই শেষ। কিন্তু এটাতো গল্প নয়, এটা হলো আমাদের তথাকথিত বর্তমান সমাজের জ্বলন্ত প্রতিচ্ছবি। আমাদের চারপাশে চলছে অকথ্য বধূ-নির্যাতন। আর এই বধূ নির্যাতন একটা সামাজিক অপরাধ।
অথবা আপনারা কি জানেন……..? ? ?
• পণ দিলে, পণ নিলে, অথবা পণ দেওয়া নেওয়ার ব্যাপারে কোনওরকম সাহায্য করলে ৫ বছরের কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে ১৫,০০০ টাকা (অথবা যৌতুকের মূল্য - যেটি বেশি পরিমান) জরিমানা হবে। তবে আদালত কারণ দেখিয়ে কারাদণ্ডের সময় কমাতে পারে। (বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই অভিযোগগুলিতে অভিযুক্ত হলে, অভিযুক্ত ব্যক্তিদেরই প্রমাণ করতে হবে যে তারা নিরপরাধ)।
• প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে পণের দাবী করলে ৬ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হবে। যদি কোন খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন মারফত্ পণের প্রলোভন দেখানো হয়, তাহলে সেই বিজ্ঞাপনদাতার ও কাগজের মুদ্রক, প্রকাশক ও প্রচারকের ৬ মাস থেকে ৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা ১৫,০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। তবে উভয়ক্ষেত্রেই আদালত কারণ দেখিয়ে কারাদণ্ডের সময় ৬ মাস থেকে কমাতে পারে।
• কেবল নির্যাতিতা নারী নয়, যে কোন সমাজকল্যানমূলক প্রতিষ্ঠানের অভিযোগও আদালতে মামলার জন্য গ্রাহ্য হবে।
• এই অপরাধে অভিযুক্তরা কোন জামিন পাবে না এবং তাদের নিজেদের মধ্যে কোন আপোস করার সুযোগ দেওয়া হবে না।
• অভিযোগ যে কোন সময়েই আনা চলবে - তার জন্য কোনও সময়সীমা বাঁধা নেই।
এই আইনের সঙ্গে ভারতীয় দণ্ডবিধির আরও দুটি ধারা যোগ করা হয়েছে। তার বলে, পণজনিত মৃত্যু বন্ধ করার জন্য এই আইনে বিধান আছে যে, বিয়ের সাত বছরের মধ্যে কোনও নারীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে পুলিশকে সে ব্যাপারে তদন্ত করতে হবে। পণজনিত কারণে মৃত্যু ঘটলে অপরাধীদের ৭ বছর থেকে যাবজ্জীবন পর্যন্ত কারাদণ্ড হবে।
এছাড়া,যদি কোন স্বামী বা তার আত্মীয় বধূর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে যাতে বধূটি আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত হয় বা তার শারীরিক বা মানসিক স্বাস্থ্যের হানি হয়, তাহলে তার (বা তাদের) ৩ বছরের পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড হতে পারে। সম্পত্তি বা অন্যান্য বে-আইনী আর্থিক দাবী মেটাবার জন্য (বা মেটাতে না পারার জন্য) বধূকে উত্তক্ত করাটাও উপরোক্ত নিষ্ঠুর আচরণের সংজ্ঞায় পরবে।
ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ১২৫ থেকে ১২৮ ধারা, ১৯৭৩
এই আইনের বলে ডিভোর্স বা বিবাহ-বিচ্ছেদ হলে নারীরা নিজেদের ও সন্তানদের ভরণপোষণের জন্য কোর্টে আবেদন করতে পারেন এবং কোর্টে যাতে এগুলির দ্রুত নিষ্পত্তি হয় তার বিধান আছে। এই আইন যখন প্রণয়ন করা হয়েছিল, তখন সমস্ত নারীদের জন্যই এটি প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু ১৯৮৬ সালের মুসলিম আইন অনুযায়ী, মুসলিম নারীরা সাধারণভাবে আর এই আইনের অন্তর্গত নন।
ভারতীয় দণ্ডবিধি ৪৯৮-ক ধারা
বধূ-নির্যাতন বন্ধ করার উদ্দেশ্যে এই ধারাটি ফৌজদারি আইনে যুক্ত করা হয়। এই আইন অনুসারে স্বামী বা তাঁর কোনও আত্মীয় বধূর ওপর নির্যাতন করলে, তাঁরা গুরুতর অপরাধী বলে গণ্য হবেন। নির্যাতিতা বধূ নিজের নিরাপত্তার জন্য পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করলে, পুলিশ সেই অভিযোগ নথিবদ্ধ করবে এবং সঙ্গে সঙ্গে তদন্ত শুরু করবে। যুক্তিসঙ্গত হলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে বাধ্য।
আসুন, প্রচলিত বধূ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার হয়ে উঠে প্রতিবাদ করি। তাদের উপযুক্ত মর্য্যাদা দিই। আমরা সকলেই সমবেতভাবে বর্তমান সমাজে প্রতিষ্ঠা করি বধূ-নির্যাতন মুক্ত স্বচ্ছ, নির্মল একটা নতুন সমাজ। যেখানে নারীরা পাবে তাদের উপযুক্ত মর্যাদা। সাথে থাকুন, পাশে রাখুন। জয়গুরু।
রচনাকাল : ৩০/১০/২০১৯
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।