ভালবাসা শুধু ভালবাসা (চতুর্থ পর্ব)
কান্না দিয়ে কেনা ভালবাসা
লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান চৈতালী। চৈতালী জন্মান্ধ। ছোট বেলায় বাবাকে হারিয়েছে। বিধবা মায়ের সাধ্য নেই মেয়ের বিয়ে দেওয়ার। আর তাছাড়া অন্ধ মেয়েকে কেইবা বিয়ে করবে? চৈতালীর মনে বড় দুঃখ। কি সুন্দর এই পৃথিবী। কত গাছপালা, পশুপাখি, পাহাড়, পর্বত -কন্দর নদ-নদী। সে চোখে দেখতে পায় না। কিন্তু কল্পনার চোখ দিয়ে সবই তার কাছে অতি সুপরিচিত।
দিন যায়, রাত আসে। রাত কাটে ভোর হয়, শুরু হয় নতুন দিনের সুচনা। এমনি করেই আঠারোটা বসন্ত পার হয়ে গেছে চৈতালীর জীবনে। চৈতালী বুঝতেই পারে নি কেমন করে কেটে গেছে তার জীবনের ফেলে আসা দিনগুলো। মাকে এখন সে কিছুটা সাহায্য করে থাকে। চৈতালীর গানের গলা ছিল অদ্ভুদ। সহজেই সে গান মুখস্থ করে নিতো আর হারমোনিয়ামে সুর সংযোজিত করে সবাইকে আকৃষ্ট করতো। পাড়ার ছেলেরা চাঁদা তুলে চৈতালীকে একটা গানের স্কুল খুলে দিল। গান শিখতে যারা আসতো তাঁদের পয়সায় মা তার সংসার চালাতো। চৈতালীও এতে কিছুটা আনন্দও উপভোগ করতো। সে গর্বিতা কেননা সে তার মায়ের বোঝা কিছুটা হালকা করতে পেরেছে।
সেদিন বেশ খুশি মনেই অনুপম এসে বললো, “মাসীমা! আমি সব ব্যবস্থা করেছি। আগামীকাল চৈতালীর চোখ অপারেশন করা হবে। কোন এক সহৃদয় ব্যক্তি তার একটি চোখ দান করবেন। একজন সমাজসেবী ডাক্তার বিনা খরচে তার নার্সিংহোমে তার অপারেশন করে চৈতালীর দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেবেন। চৈতালী তখন গানের ক্লাসে শিক্ষার্থীদের গান শেখাচ্ছিল।
চৈতালী গাইছে-
“আমার এই চোখ দিয়ে
পৃথিবীর সব আলো
আমি তোমায় দেখাবো
বলনা কুহু সুরে
কোন পাখি ডাকে দূরে।।
ডালে ডালে কোয়েলিয়া
কোয়েলের সন্ধানে
গান গায় প্রেমের সুরে
বলনা কুহু সুরে
কোন পাখি ডাকে দূরে?”
চৈতালীর কাছে সবকিছুই গোপন করা হলো। পরদিনই সকালে তাকে নার্সিং হোমে ভর্তি করা হলো।
অপারেশন থিয়েটার। চৈতালী বেডে শুয়ে আছে। চৈতালী শুয়ে শুয়ে ভাবছে কে সে হৃদয়বান পুরুষ যিনি তাকে তার একটা চোখ দান করবেন। ভাবতে ভাবতে সে চোখ দুটো দারুণ ঘুমে জড়িয়ে পড়ল। এরপর কি হয়েছে চৈতালী জানে না। জ্ঞান যখন ফিরলো তখন সে বুঝতে পারলো তার চোখ দুটো পুরু কাপড় দিয়ে বাঁধা।
ডাক্তার বললেন- এবার তোমার চোখের পুরু কাপড় খুলে দেওয়া হবে। তুমি ধীরে ধীরে চোখ খুললেই সবকিছু দেখতে পাবে। চৈতালী বলে উঠে- আচ্ছা ডাক্তারবাবু! যিনি আমায় চোখ দান করেছেন তাকে আমি দেখতে পাব ?
“হ্যাঁ, অবশ্যই”। ডাক্তারবাবু ইশারায় অনুপমকে ডাকে।
অনুপম সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখে কালো চশমা। ডাক্তারবাবু চৈতালীর চোখের কাপড় খুলে দিলেন। বললেন- “এবার ধীরে ধীরে তোমার চোখ খুলো”।
চোখ খুলতেই চৈতালী প্রথমে অনুপমকে দেখতে পেল। তার চোখে কালো চশমা দেখে চৈতালী সব বুঝতে পারলো। খুশির আনন্দে চৈতালীর দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। “এ তুমি কি করলে অনুপম! এতো আমি চাইনি। ” চৈতালী কাঁদতে থাকে।
অনুপম বলে, “দুঃখ কোর না চৈতালী এতদিন চোখে আমি একাই দেখতাম। এবার থেকে আমার চোখ দিয়ে তুমি আমাকে দেখছো এর চেয়ে বড় আনন্দের আর কি হতে পারে? ওরা দুজনে একসাথে ডাক্তারবাবুকে প্রণাম করে।
চৈতালীর আজ বড় আনন্দের দিন। তার চোখ দিয়ে দেখতে লাগল চারদিক। চৈতালী অনুপমকে জড়িয়ে ধরে বলে- “আমার সামনে থেকে পৃথিবীর সব আলো নিভে গিয়েছিল, তুমি নতুন করে তা আবার জ্বেলে দিয়েছো? পৃথিবীতে কত আলো। সবুজ গাছপালা, পশুপাখি – ইত্যাদি।
আনন্দে চৈতালী গেয়ে ওঠে- “সুন্দর পৃথিবী – সৃষ্টি করেছো তুমি, তোমারে জানাই প্রণাম। ওগো ঘনশ্যাম…… তুমি যে আমার।”
দুইজনে একসাথে নার্সিংহোম থেকে বাড়ির পথে পা বাড়ালো।
গল্প এখানেই শেষ। কিন্তু এটাতো গল্প নয়। সমাজের আনাচে কানাচে, গ্রাম নগর, শহর, অলিতে গলিতে, যারা দৃষ্টিহীন, আঁধারের বুকে মুখ লুকিয়ে যারা আজও কাঁদছে, আসুন, আমরা তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই। মনে রাখবেন মরণোত্তর চক্ষুদান এক মহত্ দান।আপনার দেওয়া চোখের বিনিময়ে কোন একজন অন্ধের দৃষ্টি ফিরে আসতে পারে। সহানুভুতির পরশ দিয়ে অন্ধজনের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিন। সাথে থাকুন, পাশে রাখুন। জয়গুরু!
রচনাকাল : ২৫/১০/২০১৯
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।